বিবিসি-র দক্ষিণ এশিয়ার প্রাক্তন সংবাদদাতা, বিশিষ্ট সাংবাদিক মার্ক টালি তাঁর নো ফুল স্টপস ইন ইন্ডিয়া (১৯৯১) বইতে লিখেছিলেন, কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দাঙ্গা বা ঘটনা-দুর্ঘটনার খবর সংগ্রহ করে ফেরার পথে সাংবাদিকের খালি মনে হতে থাকে, “আমার খবরটা আজ সবচেয়ে বড় খবর হবে।” ভুলে যায় তাঁদের কথা, যাঁদের খবর সংগ্রহে সে গিয়েছিল। তাঁরা পড়ে থাকেন তাঁদের যন্ত্রণা, সমস্যা নিয়ে; সাংবাদিক পেয়ে যায় বড় খবর করার প্রশস্তি।
কথাটা মনে পড়ছিল, যখন দীর্ঘ ৩৫ বছর পর ফিরে গেলাম আমার করা একটা খবরের কাছে। দিনটা ছিল ১০ নভেম্বর, ১৯৯০। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। কলকাতার প্রেস ক্লাবে সন্ধ্যা কাটিয়ে বেরোনোর সময়ে টিভিতে খবর শুরু হল। আবছা কানে এল, একটা বিমানের যাত্রাপথ ঘুরিয়ে জোর করে অন্য কোথাও নামানো হয়েছে। মনে পড়ে, প্রথমেই মনে হয়েছিল, “যে শহরে বিমানটা নামানো হয়েছে, সেখানকার সাংবাদিকদের আজ বিরাট ঝক্কি।” অচিরেই এল অফিস থেকে ফোন— সেই বিমান নেমেছে কলকাতাতেই!
বিমানবন্দরে গিয়ে দেখা গেল, বিমানটি তাই এয়ারলাইনস-এর টিজি-৩০৫। ব্যাঙ্কক থেকে ইয়াঙ্গন যাওয়ার পথে জোর করে কলকাতায় অবতরণ করানো হয়েছে। ভিতরে ২২০ জন যাত্রী, পাইলট ও কর্মীরা আছেন। রাজ্যের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব মণীশ গুপ্ত বিমানবন্দরে এসে এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলের টাওয়ারে চলে গেলেন, বিমানের পথ পরিবর্তনকারীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে। খানিক পরে আনা হল এক বৌদ্ধ ভিক্ষুকে, দোভাষী হিসাবে।
ইতিমধ্যে দিল্লি থেকে উড়ে এসেছে এই ধরনের পরিস্থিতিতে উদ্ধারকার্যে বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষিত বাহিনী। দূর থেকে দেখা গেল, তাঁরা বিমানের পিছন দিক থেকে বিমানের নীচে পজ়িশন নেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন। রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি। পরে শুনেছি, কলকাতার আধিকারিকরা তাঁদের বুঝিয়েছিলেন, এখনই বিমানের কাছে না যেতে।
বেশ কিছু ক্ষণ অপেক্ষার পরে হঠাৎ শুনলাম, সাংবাদিক সম্মেলন হবে। দেখা গেল একটা বাস যাচ্ছে বিমানের দিকে। বাসে রয়েছেন মণীশ গুপ্ত। পরে জেনেছি, তৎকালীন ডিআইজি সিআইডি রজত মজুমদারও বন্দুক নিয়ে সিটের নীচে লুকিয়ে বসে ছিলেন। কারণ শর্ত ছিল, স্বরাষ্ট্র সচিব একা যাবেন। যাত্রীরা একে একে বেরোলেন। তাঁদের চোখে-মুখে কিন্তু আতঙ্কের তেমন কোনও ছাপ নেই। অনেকে যাওয়ার আগে দুই তরুণের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন, তা-ও লক্ষ করলাম।
সেই দুই তরুণ সোয়ে মিন্ট (ছবি) এবং হিতিন কাও। তাঁরাই বিমানের গতিপথ ঘুরিয়ে এনেছেন কলকাতায়। তাঁদের আনা হল সাংবাদিক সম্মেলনে। তাঁরা দেখালেন, তাঁদের কাছে কোনও অস্ত্র ছিল না। এক জন একটা বুদ্ধমূর্তি, অপর জন একটা গোল সাবান রুমালে ঢেকে রেখেছিলেন হাতে, তার উপরে রাখা ছিল কিছু তার। তাঁরা বললেন, কারও ক্ষতি করা তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল না। তাঁরা মায়ানমারের গণতান্ত্রিক নেত্রী আন সান সু চি-র সমর্থক। তাঁদের ক্ষোভ, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম তাঁদের গণতান্ত্রিক আন্দোলন নিয়ে খবর করে না। রাজ্য সরকারের কাছে তাঁদের একমাত্র শর্ত ছিল, সাংবাদিক সম্মেলন করতে দিতে হবে। কলকাতায় বিমান অবতরণ করানোর উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করা।
আজ ভাবলে আশ্চর্য লাগে, ওই দুই তরুণের বিরুদ্ধে তাই বিমান সংস্থা বা কোনও যাত্রী কোনও অভিযোগ দায়ের করেনি। ভারত সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারও হয়তো তাঁদের গণতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল, অথবা থাকতে পারে কূটনৈতিক সম্পর্কের কোনও হিসাবও। কিছু দিন পরেই দু’জনের জামিন হয়ে যায়। খবর এল, দু’জন দিল্লিতে রয়েছেন তদানীন্তন এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বাড়িতে। হিতিন কাও সেখান থেকে বিদেশ চলে যান। সোয়ে মিন্টকে কলকাতায় আনা হয় মামলার বিচার শুরুর জন্য।
এর মধ্যে বছর দশেক কেটে গিয়েছে। মহাকরণে সাংবাদিকদের সঙ্গে দৈনিক প্রশ্নোত্তরের সময় মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে মায়ানমারের মিন্ট এবং কাওয়ের মামলার বিষয়ে প্রশ্ন করতে উনি কোনও উত্তর না দিয়ে ঘরে ঢুকে গেলেন। পরে একান্তে জানালেন, কেন্দ্র ও রাজ্য, উভয় সরকারেরই সহানুভূতি রয়েছে ওই দুই তরুণের প্রতি, কিন্তু প্রকাশ্যে তা বলা যাবে না। শেষ অবধি প্রমাণের অভাবে সোয়ে মিন্ট বেকসুর খালাস হয়ে গেলেন।
সোয়ে মিন্ট স্বয়ং সাংবাদিক। ১৯৯৮ সালে দিল্লিতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘মিজ়িমা’ সংবাদ সংস্থা। এখন নানা দেশে তাঁর সংস্থা দফতর খুলেছে। মায়ানমারের ভিতরে এবং বাইরে প্রতি দিন তিন কোটিরও বেশি তাঁর পাঠক-দর্শক। পেয়েছেন শান্তি ও সাংবাদিকতার জন্য নানা আন্তর্জাতিক পুরস্কার। দেখা হয়ে গেল সম্প্রতি দিল্লিতে, প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়ার একটি অনুষ্ঠানে। আজ তিনি আটান্ন বছরের প্রৌঢ়। মারণ রোগে আক্রান্ত। তবু প্রত্যয় অটুট। বললেন, “মায়ানমারে গণতন্ত্র নেই। নেত্রী সু চি বন্দি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই এখনও চলছে।”
সাংবাদিকের স্থান জীবনের অলিন্দে। উচিত-অনুচিতের বিচারের ও-পারে খবরের সঙ্গে যুক্ত বিচিত্র মানুষের মিছিল দেখার সুযোগ হয় তার। ক্বচিৎ-কখনও একই চরিত্র ফিরে আসে। তখন খবরের পিছনের মানুষটি তাঁর সঙ্কট, যন্ত্রণা আর সার্থকতা নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ান। সে-ও সংবাদের আর এক মাত্রা।
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে