Civic volunteer

ঔদ্ধত্যের শিকড়ে আছে শোষণ

খোঁজ করলেই জানা যায় যে, সিভিক ভলান্টিয়ারদের দিয়ে পুলিশকর্মীরা যা খুশি কাজ করিয়ে নিতে পারেন।

Advertisement

সিদ্ধার্থ শঙ্কর ঘোষ

শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২১ ০৬:৫২
Share:

কলকাতার রাস্তায় চোর সন্দেহে এক যুবকের বুকে বুট তুলে দেওয়া সিভিক ভলান্টিয়ারের কথা সম্ভবত এখনও সবাই বিস্মৃত হইনি। সেই ঘটনার ভয়াবহতাকে অতিক্রম করে যদি মূল সমস্যাটির দিকে তাকাই, তা হলে প্রথমেই যেটা চোখে পড়বে, তা হল, রাজ্য সরকার পুলিশবাহিনীতে যথাযথ কর্মী নিয়োগ না করে সিভিক ভলান্টিয়ারদের নিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কাঠামোকে চালাচ্ছে। এক জন নিয়মিত পুলিশকর্মী নিয়োগ করলে যে টাকা লাগবে, তার অনেক কমে এঁদের দিয়ে কাজ চালানো যায়। শুধু পুলিশই বা কেন, রাজ্যের বহু দফতরেই এই সিভিক-প্যারা-ক্যাজুয়াল সংস্কৃতি রমরমিয়ে চলছে। মূলত শাসক দলের দয়ার দানে নিয়োগ পাওয়ার একটা সমান্তরাল প্রক্রিয়াকে খুব বুদ্ধির সঙ্গে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। বেকার যুবক-যুবতীরা তথাকথিত ‘সরকারি’ চাকরির লোভ সামলাতে না পেরে, এই সাত-আট হাজার টাকা মাইনের দিকে ছুটে যাচ্ছেন। এই কর্মীরা চিরদিনই সরকারের মুখাপেক্ষী আর সমর্থক হয়ে থাকবেন। চমৎকার অর্থনীতি, চমৎকারতর রাজনীতি।

Advertisement

খোঁজ করলেই জানা যায় যে, সিভিক ভলান্টিয়ারদের দিয়ে পুলিশকর্মীরা যা খুশি কাজ করিয়ে নিতে পারেন। রোদ-বৃষ্টিতে ট্র্যাফিক সামলানো, দিনে-রাতে আসামি ধরা, গোয়েন্দাগিরি করা তো বটেই, অনেকে আবার থানার দালাল। কোনও অসহায় পরিবার থানা-পুলিশ করতে গেলে এঁদের দ্বারস্থ হয়। যথেষ্ট কাঞ্চনমূল্যের বিনিময়ে তাঁরা ‘সাহেব’-এর সঙ্গে সরাসরি কথা বলে কেস হালকা করে দিতে পারেন বা তুলে দিতে পারেন বলে দাবি করেন। ট্র্যাফিক সিগনালে সুযোগ পেলেই নানা আছিলায় টাকা তোলেন অনেক সিভিক ভলান্টিয়ার। পুলিশ সাহেব দূরে থেকে নজর রাখেন— ভাগ-বাঁটোয়ারা হয় পরে। আর, অনেকেরই ভাবভঙ্গি রুপোলি পর্দার চুলবুল পান্ডে বা সিম্বার মতো— দবাং!

কিন্তু, যদি এই বিপুলসংখ্যক সিভিক ভলান্টিয়ার না থাকতেন রাজ্যে, তবে অপর্যাপ্ত কর্মী নিয়ে পুলিশের কাজটা খুব কঠিন হয়ে পড়ত। আসলে তো এঁরা সামান্য বেতনে বিপুল কায়িক শ্রম দিচ্ছেন নিয়োগকর্তাকে— এ ক্ষেত্রে, রাজ্য সরকারকে। শোষণের ধ্রুপদী সংজ্ঞা মেনেই। যে মাইনেতে এঁদের কাজ করানো হয়, তাতে সংসার চালানো অসম্ভব। ফলে, উপরি রোজগারের পথ খুঁজতে হয় অনেককেই। সমর্থনযোগ্য নয়, কিন্তু বাস্তব। বিশেষত, দুই-তিন তারার অফিসাররা, মাস গেলে মোটা মাইনে পাওয়ার পরও, যখন নির্দ্বিধায় বাঁ হাতের আয় পকেটে পোরেন, তখন সিভিক ভলান্টিয়ারদের থেকে নীতিবোধের প্রত্যাশা সম্ভবত বাস্তবোচিত নয়।

Advertisement

বিভিন্ন সময় খবরের শিরোনামে অনেক সৎ এবং সাহসী সিভিক ভলান্টিয়ারের নাম উঠে আসে। মানুষ হিসাবে তখন তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যায়। কিন্তু কিছু কিছু সহকর্মীদের অমানবিক এবং অসংবেদনশীল কাজের জন্য সমস্ত সিভিক ভলান্টিয়ারের বদনাম হয়। বিভিন্ন সময়ে পুলিশের তরফ থেকে সিভিকদের জন্য প্রশিক্ষণ শিবির হয়। শেখানো হয়, কী ভাবে মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে, পাশে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু, তত্ত্বগত শিক্ষা আর ব্যবহারিক শিক্ষার ফারাক মাঝে মাঝেই চোখে পড়ে। যে সিভিক ভলান্টিয়ারটি এক জনের বুকে পা তুলে দিয়েছিলেন, তাঁর সমর্থনেও অনেক পুলিশকর্মী যুক্তি সাজিয়েছেন। এই যুক্তিক্রমই বলে দেয় যে, সুযোগ পেলে মানুষের সঙ্গে কেমন আচরণ করেন ওই সমর্থক সহকর্মীরা— কোন আচরণকে তাঁরা ন্যায্য বলে মনে করেন। পুলিশের সঙ্গে থেকে, পুলিশকে কাছ থেকে দেখে, পুলিশের আচরণ প্রবেশ করেছে সিভিক ভলান্টিয়ারদের শরীরে আর মনে, এতে আশ্চর্য হওয়ার বিন্দুমাত্র কারণ আছে কি? কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁদের মস্তানির পিছনে পুলিশের একাংশের প্রশ্রয় অস্বীকার করা যায় না। অন্য দিকে, দলের নেতা-নেত্রীর সুপারিশে পাওয়া চাকরি করতে গেলে আবার তাঁদের কথা মতো দলের কাজও করতে হবে। দল আর সরকার দুইয়ের প্রতিই দায়বদ্ধ জীবন। এ দিক ও দিক করলেই মুশকিল। শুধু দায়বদ্ধ থাকতে হবে না জনগণের কাছে, যাদের টাকায় বেতন পান।

কলকাতার পুলিশ কমিশনার ওই সিভিক ভলান্টিয়ারকে বরখাস্ত করেছেন। ভাল করেছেন। কিন্তু, তাতে সমস্যার সমাধান হবে কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন