প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের চর্চায় বাঙালির উদ্দীপনা এখনও অটুট
Bengalis in Science and technology

সেই ‘ট্র্যাডিশন’ চলছে

আত্মম্ভরিতাকে দূরে রাখতে গিয়ে নিরন্তর আত্মগ্লানির চর্চা আমাদের সর্বনাশ করছে, এটাও ভাবা প্রয়োজন। কিন্তু, পুরস্কার প্রাপ্তি বা দেশ-বিদেশের র‌্যাঙ্কিং-এ নাম তোলাই শেষ কথা কি না, সেটাও ভাবতে হবে।

Advertisement

সুগত মারজিৎ

শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৭:৫৮
Share:

Sourced by the ABP

এই বছরের শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পুরস্কার ঘোষণার পর বাঙালি হিসাবে খানিকটা গর্ব অনুভব করা গেল। অতীতে এই পুরস্কার পেয়েছেন, এমন অনেক বাঙালি বিজ্ঞানীর সঙ্গে পরিচয় এবং বন্ধুত্বের কথা মনে পড়ল। এ বঙ্গের তথা দেশটার কী হয়নি, কী হচ্ছে না, কিংবা অতীতের তুলনায় আমরা এত খারাপ আছি, এ সব শুনতে শুনতে, পড়তে পড়তে এবং বাঙালিদের বৌদ্ধিক আলোচনাসভা ও বিভিন্ন বিষয় চর্চার আসরের নেতিবাচক আবহাওয়ায় যারপরনাই বিমর্ষ হওয়ার সুযোগ পাই আমরা। ফলে সতত বৃহত্তর বিশ্বের, দেশ থেকে দেশান্তরের বিভিন্ন র‌্যাঙ্কিং-এর সন্ধান করি, পুরস্কারের খবর নিই— জানতে চাই, আমাদের সম্বন্ধে অন্যরা কী বলল।

Advertisement

নিশ্চয়ই এর প্রয়োজন আছে। কূপমণ্ডূকতা ভয়ঙ্কর নেশার বস্তু। তাই অপর্যাপ্ত আত্মসমালোচনার মাঝে বহু অপরিচিত এবং পরিচিত নিরলস সংগ্রামী বাঙালির বিভিন্ন ধরনের চর্চায় অপূর্ব কেরামতির দিকে আর একটু সহানুভূতির দৃষ্টি দিয়ে তাঁদের এবং আগামী প্রজন্মকে একটু উৎসাহিত করার প্রয়োজন রয়েছে বিলক্ষণ। আত্মসচেতনতা একমাত্রিক হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। আত্মম্ভরিতাকে দূরে রাখতে গিয়ে নিরন্তর আত্মগ্লানির চর্চা আমাদের সর্বনাশ করছে, এটাও ভাবা প্রয়োজন। কিন্তু, পুরস্কার প্রাপ্তি বা দেশ-বিদেশের র‌্যাঙ্কিং-এ নাম তোলাই শেষ কথা কি না, সেটাও ভাবতে হবে।

মনে পড়ে যায়, কিছু বছর আগে দেশের বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তাদের একটি আলোচ্য বিষয় ছিল যাঁরা গবেষণা করতে আসছেন, তাঁদের আঞ্চলিক পরিচিতির ব্যাপারটি। দেখা গেল যে, বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে বড় অংশ আসছেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে। মনে রাখতে হবে, এই সব প্রতিষ্ঠানে গবেষণার সুযোগ পেতে গেলে মেধা যাচাইয়ের পরীক্ষায় যে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়, সেই প্রতিযোগিতার ধারেকাছে পৃথিবীর শয়ে শয়ে বিশ্ববিদ্যালয় আসতে পারে না। সেই সব প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ অর্জন করা গবেষকের ছোটবেলা থেকে বড়বেলার ইতিহাসের পরতে পরতে একেবারে অচেনা অখ্যাত স্কুল-কলেজ এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অবদান, এবং সর্বোপরি পড়াশোনাকে নিরন্তর সম্মান করা পরিবারের গঠিত আত্মত্যাগের কাহিনিও ফেলে দেওয়ার মতো নয়।

Advertisement

আজকাল অনেকে কথায় কথায় ‘দায়িত্ব’ নিয়ে মিথ্যে কথা বলেন। তবুও এ কথা হয়তো দায়িত্ব নিয়েই বলা যায় যে, তেমন ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল। অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মতো বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির জ্ঞানচর্চায় বাঙালির উৎসাহ উদ্দীপনা এবং ক্ষমতার কোনও ঘাটতি হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। আমার এক প্রিয় মাস্টারমশাই একটি অত্যন্ত খাঁটি কথা বলেছিলেন— প্রচার ও প্রতিষ্ঠা এক জিনিস নয়। ভাটনগর পুরস্কার যাঁরা পাননি, এমন অনেক বিজ্ঞানীও আছেন, যাঁরা পাদপ্রদীপের আলোর ছোঁয়া না পাওয়া সত্ত্বেও অভূতপূর্ব সম্মানের অংশীদার হয়েছেন। এ কথাও সত্যি যে, অন্যান্য বিষয়ে যে ক্ষেত্রে পুরস্কারের সংখ্যা কম, সে ক্ষেত্রেও প্রতিভাধর বাঙালি গবেষকের সংখ্যা কম নয়।

বিদেশের একটি বিখ্যাত দৈনিকের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে চন্দ্রযান প্রকল্পের ভূয়সী প্রশংসা করে বলা হয়েছে সেখানে কর্মরত বিভিন্ন মহিলা গবেষকের কর্মক্ষমতা এবং একই সঙ্গে তাঁদের ঘর-গৃহস্থালি সামলানোর কথা। যদিও এটা আমাদের দেশের এক চিরকালীন লজ্জার কাহিনি যে, সংসার সামলানোর দায় মহিলাদের উপরেই চাপিয়ে দেওয়া হয়। তবুও এ কথা অনস্বীকার্য যে, নামকরা সংস্থায় কাজকর্মের চেয়ে হয়তো দেশের অভ্যন্তরের বিজ্ঞানচর্চায়, প্রযুক্তিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এবং তার কার্যকারিতাকে বিশ্বমানের করে তোলায় স্বদেশি গবেষকদের এক অর্থে অবদান অতুলনীয়। শ্রীহরিকোটায় রকেট উৎক্ষেপণের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক যন্ত্রাংশ তৈরিতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদানের কথা শুনেছি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কলকাতার বাইরের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা তরুণ গবেষকদের দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উপস্থিতি এবং গবেষণার ক্ষেত্রে সুপরিচিতি মনগড়া গল্প নয়।

কেউ কেউ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলেন যে, “সবই তো বুঝলাম, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে কী হচ্ছে?” এই কথাটি মনে রাখতেই হবে যে, বাঙালি পশ্চিমবঙ্গের বাইরে গেলে অবাঙালি হয়ে যায় না। আমি তাঁদের অনুরোধ করব, যে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজে তাঁদের ছেলেমেয়ে বা নাতি-নাতনিরা পড়লে তাঁরা মর্মাহত হবেন, সেই সব জায়গার গত বিশ বছরে ভাল ছাত্রছাত্রীরা কে কী করছে, তার একটা হিসাবনিকাশ করুন, উত্তরটা নিজেরাই পেয়ে যাবেন। আমি ২০১১ সাল থেকে বেশ কিছু বছর সেই সব হিসাবনিকাশের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত ছিলাম, তাই বলছি। বাড়িতে দু’টি ভাত খেয়ে কাছের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে গবেষণা করে বাড়িতে ফিরে আসবেন, পৃথিবীর কোথাও এটা হয় না। এ চত্বরে আইএসিএস, আইআইসিবি, আইআইএসইআর-এর অধ্যাপকদের পড়াশোনার বহর কত দীর্ঘ, সে সম্পর্কে আঁচ করতে গেলেও খানিকটা শিক্ষার প্রয়োজন হয়।

পরিকাঠামো এবং গবেষণায় বিনিয়োগের অসমতা এ দেশটাকে এবং রাজ্যটাকে গিলে খেয়ে ফেলছে। এর অনেকটাই মেধার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। রাজনীতি যেমন এ রাজ্যে শিল্পায়নকে বহু দিন স্তব্ধ করে রেখেছে, তেমনই তথাকথিত শিল্পে টইটম্বুর রাজ্যের পড়াশোনার উচ্চতা মাপার শক্তি নেই, এটাও সত্যি। এখানে ব্যবসায়ীরা বড়লোক হলে সোনার বাসনে ভোজসভা ভরে যায়, গবেষণায় সেই টাকা আসে না। কিংবা কেউ কেউ আমেরিকার বিশ্ববিখ্যাত বিদ্যায়তনে কোটি কোটি ডলার অনুদান দিয়ে নিজেদের খ্যাতি বাড়ানোর চেষ্টা করেন। শুধু রাজনীতির মানুষদের গালমন্দ করেই বা কী হবে!

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার সময় দেখেছি, কোনও তরুণ অধ্যাপক নেচার বা সায়েন্স-এ গবেষণাপত্র ছাপিয়ে একগাল হেসে বলতে আসতেন। এ শহরেই হাসপাতালের আউটডোরে দিনে ছ’সাতশো রোগী দেখা ডাক্তার এ সব পত্রিকায় গবেষণাপত্র ছাপান। আইআইএসইআর কলকাতার সিনেট সভ্য থাকাকালীনও এই অভিজ্ঞতা হয়েছে। আর এটাও জানি যে, এগুলোই শুধু নয়, অলক্ষ্যে মেধার সাধনা সংগ্রাম করে চলেছে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বার এক জাপানি নোবেলজয়ী অধ্যাপক এসেছিলেন। যত দূর মনে পড়ছে কেমিস্ট্রি ছিল বিষয়। তাঁর সঙ্গে কথা বলার লোভ সামলাতে না পেরে মধ্যাহ্নভোজনে আমন্ত্রণ করে ফেললাম। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বলুন তো নোবেল পুরস্কার পাওয়ার মূল মন্ত্রটি কী? অবশ্যই হাস্যরসরঞ্জিত ছিল প্রশ্নটি। তিনি চটজলদি বললেন, “একটি কারণ অবশ্যই নোবেলজয়ী অধ্যাপকের সঙ্গে কাজ করা, না হলে আপনার কাজ সেই স্তরে পাত্তাই পাবে না।” উত্তরটি যে একেবারে জানা ছিল না তা নয়, আবার মনে পড়ে গেল প্রচার ও প্রতিষ্ঠান একত্র হওয়া পুরস্কার পাওয়ার পক্ষে বিশেষ প্রয়োজনীয়।

যুগধর্মকে অস্বীকার করা বোকামি। পুরস্কার বা র‌্যাঙ্কিং, এ সব দিয়েই গবেষণার মানদণ্ড নির্ধারিত হয়, আর সেই মানদণ্ড ব্যবহার করেই গবেষকরা নিরন্তর নিরলস প্রয়াস করেন রসদ জোগাড় করার। রসদ ছাড়া গবেষণার কোনও সুযোগই নেই, তাই পুরস্কার নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু, সব সময় ‘নেতি নেতি’ আখ্যান একটি জাতি, একটি গোষ্ঠী, একটি পরিচিতিকে শুধু অকারণ অপদস্থ করে তা নয়, চাবুক মেরে জয়গানের নামে লোকটাকেই মেরে ফেলতে পারে।

অন্য দিকে, পণ্ডিত রবিশঙ্কর বা উস্তাদ বিলায়েত খানই যদি শুধু সেতার বাজাতেন, তা হলে কি সেতার এক প্রসিদ্ধ যন্ত্র হত, যদি না দীর্ঘ দিন ধরে বহু মানুষ এ রাজ্যে শাস্ত্রীয় সেতার বাজনাকে মাথায় তুলে রাখতেন? পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ই বা হতেন কী করে! এ রাজ্যে পড়াশোনা এবং মেধা চর্চার সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। তার গতি রুদ্ধ করে
কার সাধ্যি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন