হিন্দু বা ইসলাম ধর্ম ছাড়াও বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন ইত্যাদি ধর্মেও উপবাস পালনের প্রথা আছে। বিশেষ দিন, তিথি বা মাসে পূজা বা প্রার্থনাপর্ব শেষ না হওয়া অবধি উপবাস পালন করতে দেখা যায়। উপবাস মূলত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের অঙ্গ হলেও, অস্ত্রোপচার বা কিছু কিছু মেডিক্যাল পরীক্ষার এবং সাধারণ অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগের আগে নির্দিষ্ট কয়েক ঘণ্টা না-খেয়ে থাকতে বলা হয়। এ ছাড়াও, দেহে ক্যালোরিক তাপশক্তি কম করার জন্য বা স্থূলতা কমাতেও স্বাস্থ্যসচেতন মানুষকে না খেতে বা কম খাবার খেতে দেখা যায়।
উপবাসে কি শরীরে উল্লেখযোগ্য কোনও উপকার হয়? এ বিষয়ে গবেষণার ফল থেকে জানা যায়, যথাযথ মাত্রায় ‘ক্যালোরিক-রেস্ট্রিকশন’ ও পরিমিত-উপবাস তথা ‘ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং’-এ (আইএফ) প্রাণিদেহে অনেক ইতিবাচক উপকার হয় এবং একাধিক রোগ-ব্যাধির নিরাময় হয়। উপবাসের সময় শরীরের পৌষ্টিকতন্ত্র বিশ্রাম পায়, তা পরিষ্কার হওয়ার পাশাপাশি শরীরের রক্ত পরিশুদ্ধ হয়। সেই সঙ্গে, শরীরে জমা বর্জ্যপদার্থ, ফ্যাট ও দূষিত পদার্থ বা টক্সিন দূর হয়। এ ছাড়াও, রক্তচাপ, গ্লুকোজ়ের মাত্রা, কোলেস্টেরল ইত্যাদির নির্ণায়ক মাত্রায় ইতিবাচক ফল দেখা যায়। রক্তে নির্দিষ্ট ‘বায়োমার্কার’-এর উপস্থিতি বা হ্রাস-বৃদ্ধি নির্ণায়ক পরীক্ষা করে বিভিন্ন অসুখের গতিপ্রকৃতি বুঝতে পারা যায়।
আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অন এজিং-এর গবেষকরা ইঁদুর ও মানুষের ‘বিএমআই-ইন্ডেক্স’ পরিমাপ নির্ণয় করে এই সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য জানতে পেরেছেন। আইএফ-এর প্রভাবে ইঁদুর-সহ নানা জীব, ব্যাক্টিরিয়া, ইস্ট, নেমাটোড কৃমির দেহে ইতিবাচক ফল এবং জীবনকাল বৃদ্ধি লক্ষ করা গেছে। আইএফ যে শারীরিক ভাবে উপকারে আসে তার সপক্ষে নানা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মধ্যে একটি হল, উপবাসের সময় শরীরের কোষগুলি কিছুটা ‘স্ট্রেসড’ অবস্থায় থাকে, সেই ‘চাপ’ মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালায় এবং সম্ভবত রোগের বিরুদ্ধাচরণ করে। ব্যায়ামের ক্ষেত্রে যেমন মাংসপেশি ও ‘কার্ডিয়োভাস্কুলার সিস্টেম’-এর কোষগুলি ‘স্ট্রেসড’ অবস্থায় থাকে এবং পরবর্তী সময়ে তাদের উন্নতি হয়, কোষের স্ট্রেস এ ক্ষেত্রে তার সঙ্গে কিছুটা তুলনীয়।
উপবাস প্রসঙ্গে ‘অটোফেজি’র কথা অপরিহার্য। বাংলা করলে যা স্থূল ভাবে ‘স্ব-ভোজনকারী’। এ ক্ষেত্রে, শরীর নিজের ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলি গ্রাস করে। কোষের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এই ‘অটোফেজি’, গুরুত্বপূর্ণ শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে তা। মাত্রাসাপেক্ষ উপবাস বা কোনও স্ট্রেসের সময় ‘অটোফেজি’ প্রক্রিয়া উদ্দীপ্ত হয়। উপবাসের কাল ও তীব্রতার মাত্রার উপর এই প্রক্রিয়ার উদ্দীপ্ত হওয়া নির্ভর করে। শরীরের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের কুশীলব নানা টিসু এবং এই সব দেহাঙ্গের প্রাথমিক কাঠামো-একক কোষ কিন্তু প্রায়শই ক্ষয়প্রাপ্ত, ক্ষতিগ্রস্ত বা অকেজো হয়ে যায়। অটোফেজি প্রক্রিয়ায় এই কোষগুলি পুনর্ব্যবহারযোগ্য হয়ে ওঠে; কোষের পুরনো, ক্ষতিগ্রস্ত বা অস্বাভাবিক ও অব্যবহৃত প্রোটিন এবং অন্য বিনষ্ট পদার্থগুলি কোষের ক্রিয়াকলাপের জন্য পুনর্ব্যবহৃত হয়। উল্লেখ্য যে, অটোফেজি প্রক্রিয়ায় শরীরে সংক্রমণকারী ব্যাক্টিরিয়া এবং ভাইরাস ধ্বংসেও সাহায্য করে। অটোফেজি-র ‘মেকানিজ়ম’ আবিষ্কারের জন্য জাপানি সেল-বায়োলজিস্ট ইয়োশিনোরি ওহসুমি ২০১৬ সালে মেডিসিনে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
উপবাস আর উপবাস শেষে খাদ্যগ্রহণ দু’টি স্বতন্ত্র দশা। প্রথম ক্ষেত্রে শরীরে খাদ্য থাকে না, তাই শরীরের কোষগুলি তখন লিপিড ও ফ্যাটি অ্যাসিড থেকে শক্তি সঞ্চয় করে। উপবাস শেষে খাদ্যগ্রহণের সময় পৌষ্টিকতন্ত্রের স্টেম-সেলের ‘রিজেনারেশন’ পর্ব উদ্দীপ্ত হয়, যা পৌষ্টিকতন্ত্রের উন্নতির সহায়ক। স্টেম-সেলগুলি এই সময় সক্রিয় ‘সেলুলার মাস’ এবং অন্ত্রের আস্তরণকে পুনরুজ্জীবিত করে। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্কতার দিকগুলিও মনে করিয়ে দিয়েছেন। দুর্বল, অসুস্থ ও অতিবৃদ্ধদের ক্ষেত্রে উপবাস শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। উপবাস ভাঙার সময়ও সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, যথাযথ আহার নির্বাচন ও ধীরে ধীরে খাওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ।
সাম্প্রতিক কালে নেচার গবেষণাপত্রের ফলাফলেও ‘ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং’ এবং কার্যকর ক্যালোরিক-রেস্ট্রিকশনের কারণে বেশ কিছু প্রাণিদেহে ইতিবাচক উপকার-সহ সুস্থতা বিষয়ক তথ্য জানতে পারা গিয়েছে। আমেরিকায় এমআইটি-র গবেষকরা ইঁদুর মডেলের উপর গবেষণা করে ফলাফল প্রকাশ করেছেন। মানবদেহে উপবাসের প্রভাব সংক্রান্ত বিষয়গুলি যদিও এখনও অনেকাংশেই ‘অনাবিষ্কৃত’। উল্লেখ্য, গবেষণার ফলাফলে দেখা গিয়েছে যে, যথাযথ মাত্রায় করা আইএফ-এর কারণে শরীরে উপকার দেখা গেলেও, অন্য দিকে তা যথেষ্ট আশঙ্কাজনকও বটে। তাঁরা উল্লেখ করেছেন, উপবাস শেষে খাদ্যগ্রহণের সময় ‘রিজেনারেশন’ দশায় যদি কোনও ‘ক্যানসারাস মিউটেশন’ তৈরি হয়, সে ক্ষেত্রে ‘ইনটেস্টিনাল টিউমর’ তৈরি হওয়ার খুব বেশি ঝুঁকি থাকে। ইঁদুরের ক্ষেত্রে এই সম্ভাবনা বেশি। বলা বাহুল্য, এই গবেষণার ফলাফলে মানুষের অনিয়ন্ত্রিত উপবাস এবং তজ্জনিত ‘রিজেনারেশন’-পর্বে ওই জাতীয় কোনও ঝুঁকির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
একুশ শতকে অন্তত এটুকু নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, অন্ধবিশ্বাস বা ধর্মরীতি নয়, বিজ্ঞান-গবেষণাই শেষ কথা বলবে— উপবাস মানবশরীরের জন্য কতটা উপকারী, তাতে প্রাণঘাতী রোগ-আশঙ্কার ঝুঁকিই বা কতটা।
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে