????: ???? Sourced by the ABP
এই বিশ্বকে লয়ে আনমনে যে প্রৌঢ় শিশুটি খেলে চলেছেন তার মাসুল গুনতে গুনতে শেষ হচ্ছে দু’হাজার পঁচিশ। প্রশ্ন উঠছে, যে নতুন বছর আজ জাগ্রত দ্বারে, কতটা আঁধার সে সইতে পারবে? অতি বড় আশাবাদীও মর্ম থেকে টের পাচ্ছেন, ‘এ বড়ো সুখের সময় নয়, এ বড়ো আনন্দের সময় নয়’।
শেষের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা এই ক্যালেন্ডার বর্ষ আসলে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের, যেখানে আমরা বসবাস করছি! ২০২৫-কে গড়েপিটে উপসংহারের দিকে এগিয়ে দিল যে সমূহ বিষয়বৈচিত্র, তার মধ্যে ট্রাম্পের পূর্বাভাসহীন, কূটনৈতিক সাধারণ ধারণা ও প্রোটোকলকে কাঁঠালি কলা দেখানো নীতির ছাপ যেমন রয়েছে, তেমনই তাঁর নির্মাণ ব্যবসায়ের পূর্ব বিশুদ্ধ দেনাপাওনায় হিসেবি মনের ছায়া ঘনিয়েছে। শুল্কযুদ্ধ ঘোষণা করে আন্তর্জাতিক অর্থব্যবস্থাকে তছনছ, ন্যাটোর প্রতি আমেরিকার দায়বদ্ধতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার কশেরুকা দিয়ে হিমস্রোত প্রবাহিত করে চলেছে বছরভর। শুধু অর্থনীতি নয়, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা পরিস্থিতিও কেতরে পড়েছে গরম তেলে চোবানো মথের মতো।
বহু রক্তপাতের পর গাজ়ায় দুর্বল এক সংঘর্ষ বিরতিতে পৌঁছনো গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ভিতরের আগুন প্রশমিত হয়নি আদৌ। শুধুই বারুদের গন্ধ ইউক্রেন থেকে সুদানে, ভেনেজ়ুয়েলায় নতুন করে হিংসার সম্ভাবনা, ভারত পাকিস্তান সীমান্ত অশান্ত। ক্রমবর্ধমান এই অস্থিরতাকে সামাল দিতে ভুক্তভোগী সরকারগুলি প্রতিরক্ষা খাতে খরচ এতটাই বাড়িয়ে দিয়েছে, যা ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ের পর আর দেখা যায়নি। এর ফলে যা ঘটার তাই ঘটেছে, উন্নত, ধনী পশ্চিমের দেশগুলি আন্তর্জাতিক অনুদানের বহর চোখে পড়ার মতো কমিয়ে দিয়েছে। সংঘাতে জড়িয়ে থাকা দেশগুলির ভাঁড়ারে টান ধরছে। গ্লোবাল সাউথের কোমায় যাওয়ার দশা ক্ষেত্রবিশেষে।
পঁচিশের ক্যালেন্ডার নিরাপত্তাহীনতার যে বেশ কয়েকটি ঝোঁক তৈরি করেছে, আগামী বছরকে তার মুখোমুখি হতে হবে নিশ্চিত। যার মধ্যে বিপজ্জনক তালিকার একেবারে গোড়ায় থাকছে পরমাণু অস্ত্রের রোয়াব এবং ভয় দেখানোর মতো ঘটনাক্রম। পরমাণু এবং সাধারণ ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা নিরীক্ষার যে ধুম লেগেছে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলির তাতে দিগন্তে সিঁদুরে-রং লাগছে। চুপিসারে চিনের অস্ত্রভান্ডার যে কোথা থেকে কোথায় পৌঁছচ্ছে, তার নির্দিষ্ট আন্দাজও কারও রয়েছে বলে মনে হয় না। মন্ত্রগুপ্তি, অনৃতভাষণ এবং স্বভাবগোপনীয়তায় চিনের মতো খেলোয়াড় আর কে আছে এই ভুবনে! অস্ত্রদৌড়ে রাশিয়া বা আমেরিকাকে তা যে ছুঁয়ে ফেলেনি তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।
বিশ্বের কৌশলগত ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে ঘটনা প্রবাহে। বছরের গোড়ায় ফেব্রুয়ারিতেই মিউনিখ নিরাপত্তা কনক্লেভে দেওয়া ভাষণে আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, ট্রাম্পের নতুন সরকারের ইউরোপের প্রতিরক্ষা নিয়ে মাথাব্যথা নেই, ন্যাটোর পারস্পরিক প্রতিরক্ষা গ্যারান্টির প্রতি অবিশ্বাসও পোষণ করছেন তাঁরা। ইউক্রেন প্রসঙ্গ এবং রাশিয়ার পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি এই মন্তব্য করেছিলেন সে সময়ে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে মে মাসে চার দিনের সঙ্কট, দু’টি পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রকে খোলা যুদ্ধের ময়দানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। যে কোনও মুহূর্তে তা যে আবার ফিরে আসতে পারে দক্ষিণ এশিয়ায়, সেই আতঙ্ক অটুট।
জুনে ইরানের পরমাণু কেন্দ্রে আমেরিকা-ইজ়রায়েলের যৌথ হামলা এবং তার পর আইএইএ পর্যবেক্ষণের পরিধি তেহরানে সঙ্কুচিত হওয়ার ঘটনায়, ইরানের পরমাণু প্রকল্প ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে কেউ জানে না। পশ্চিম এশিয়ায় অসুখ গভীরতর হচ্ছে, যার জেরে পরমাণু শক্তিধর পাকিস্তানের সঙ্গে পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি করল সৌদি আরব, ভারতের নাকের ডগায়। অক্টোবরে রাশিয়ার দাবি, তারা পরমাণু অস্ত্রবাহী ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছে। আর ওই একই সময়ে আমেরিকা ও রাশিয়া ৩০ বছরের পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞাকে টলিয়ে দিয়ে ফের পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষার সম্ভাবনাকে জাগ্রত করেছে। ওই মাসেরই শেষে আমরা দেখলাম দক্ষিণ কোরিয়ার পরমাণু অস্ত্রে বোঝাই জুবোডাহাজকে জলে ভাসাতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সোৎসাহ সমর্থন। এর পর উত্তর কোরিয়া হাত গুটিয়ে বসে নেই, পরমাণু অস্ত্র সম্প্রসারণের ভীতি বাড়ছে অঞ্চলে। এটাকেও মাথায় রাখা হচ্ছে, আমেরিকা এবং রাশিয়ার (বিশ্বের বৃহত্তম পরমাণু অস্ত্রের ভাঁড়ার যাদের) অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে, অর্থাৎ আর মাস দুয়েকের মধ্যেই। তার পর কী হবে, তার জন্য রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষায় শেষ হচ্ছে বছর।
যুদ্ধের অভিঘাত বদলেছে পঁচিশে এসে। তেইশ এবং চব্বিশে বাল্টিক এবং নর্থ সি-তে দেখা গিয়েছে সমুদ্র তলদেশের পরিকাঠামো বার বার আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। পঁচিশে তা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ড্রোন হামলায় পরিণত হয়েছে। বিমানবন্দর থেকে শুরু করে অতি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ঘাঁটি এখন লক্ষ্য। ড্রোনের দাপটে রাশিয়া এবং বেলারুসের সীমান্তে ইউরোপীয় দেশগুলির সার্বভৌম আকাশসীমা বার বার প্রকম্পিত হয়েছে। বেশির ভাগ দেশের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ ড্রোন-বিরোধী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই। ইউরোপের সরকারগুলিকে আগামী বছর এই বিশেষ ক্ষেত্রে সাজ-সাজ রূপে দেখা যাবে। এই সেপ্টেম্বরে পোল্যান্ডের বিদেশমন্ত্রী রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি বৈঠকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, ২০২৬-এ রাশিয়ার যুদ্ধবিমানকে গোলা ছুড়ে মাটিতে নামাবে ইউরোপের কোনও একটি দেশ। তা যদি সত্যি হয়, তা হলে হয় রাশিয়া দু’কদম পিছিয়ে যাবে, নয়তো অশান্তি বাড়বে ঘোরতর।
অগস্টে অমীমাংসিত ভাবেই শেষ হয়েছিল আলাস্কায় আয়োজিত আমেরিকা রাশিয়ার ‘বড় ম্যাচ’। গোটা বিশ্বের মতোই ভারতও তখন রুদ্ধশ্বাসে রাত জেগেছে, ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠকের অন্তিম পরিণতি দেখার জন্য। কিন্তু বৈঠকে কোনও সমঝোতা হল না রাশিয়া এবং আমেরিকার। তার পর থেকেই ট্রাম্প তাঁর চিরাচরিত রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসাবে জলে ঢিল ছুড়ছেন। কতটা ঢেউ কোথায় ওঠে, তা মেপে পরবর্তী পদক্ষেপ করছেন তাঁর নিজস্ব হিসাবে। ফ্লরিডায় সদ্য হয়ে যাওয়া আমেরিকা রাশিয়ার ইউক্রেন নিয়ে বৈঠকে আশার আবছা তরঙ্গ উঠল ঠিকই, কিন্তু তা কতটা টেকসই তা ছাব্বিশই বলতে পারবে।
পঁচিশে আরও একটি প্রবণতা প্রবল ভাবে দেখা গেল, যার প্রেক্ষাপট ছিল এতটাই প্রকট কিন্তু প্রকাশ ছিল না। বেশ কিছু ক্ষমতাবান রাষ্ট্র, বিশ্বের অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং গণ সরবরাহ ব্যবস্থার দুর্বলতাকে কাজে লাগাল নিজেদের কোলে ঝোল টানার জন্য, ভূকৌশলগত সুবিধা আদায়ের জন্য। দুর্লভ খনিজের মালিকানাকে অস্ত্রের মতো ব্যবহার করল চিন, যে খনিজ বিশ্বের যে কোনও উচ্চপ্রযুক্তির উৎপাদনে প্রাণভোমরা বিশেষ। অনেক অস্ত্র প্রযুক্তিতেও যা জরুরি। এই খনিজ রফতানিতে রাশ টেনে সেপ্টেম্বরে চিন হুঁশিয়ারি দিল আমেরিকা-সহ পশ্চিমের দেশগুলিকে। ইউরোপের গাড়ি শিল্প থরহরি কম্পমান হয়েছে এই রফতানিতে বাধা নিষেধ আরোপে। যার লাগাতার সুফল তুলছে ও তুলবে বেজিং।
এই অর্থনীতির সুযোগসন্ধানী লড়াইয়ের আগে থেকেই গা গরম করছিল ট্রাম্পের আমেরিকা। তাদের প্রযুক্তি, নিরাপত্তা এবং বাজার সংযোগের উপর আস্থা রাখা শরিক দেশগুলিকে ব্যবহার করে তারা শুল্কের জুজু দেখিয়ে সুবিধাজনক বাণিজ্য শর্ত আদায় করতে চেষ্টা করেছে একের পর এক। ট্রাম্প বিশ্বের এই নতুন ভূঅর্থনীতির জমানায় যে সব দেশ এত দিন আন্তর্জাতিক উদার সরবরাহ ব্যবস্থাশৃঙ্খলের উপর ভরসা রেখেছিল, তারা ক্রমশ বিপদগ্রস্ত। বহু দেশই, ভারতও যার ব্যতিক্রম নয়, এখন পড়িমরি করে নিজস্ব উৎপাদন দক্ষতা বাড়াতে চেষ্টা করছে, যাতে অন্যের উপর নির্ভরতা কমে। এই মরিয়া প্রয়াসে কতটা দক্ষতা বাড়বে তাতে সন্দেহ রয়েছে, বরং আগামী বছর দেশগুলির নিজেদের ভিতরেই বিশৃঙ্খলা এবং ক্ষোভের জন্ম দিতে পারে।
‘গাঢ় অন্ধকার থেকে আমরা এ-পৃথিবীর আজকের মুহূর্তে এসেছি’— বেলা অবেলা কালবেলা গ্রন্থে জীবনানন্দের এই প্রতীতি, পঁচিশের শেষে আমাদের ফের মনে করিয়ে দিয়ে গেল।
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে