আমার স্ত্রী অলকার সঙ্গে আমি ১৭ জুলাই সিসিলি পৌঁছলাম— হাতে দিনছয়েক সময়, উদ্দেশ্য দ্বীপটাকে ভাল ভাবে ঘুরে দেখা। পালেমো-র জমজমাট বাজারের রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, একটা পোস্টারে চোখ আটকে গেল। ইটালির দ্বীপে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞাপন! একটা নতুন সেলুন খুলেছে, তার বিজ্ঞাপন। নাম, বাংলাদেশ বার্বার। খুলেছেন শ্রীহারাধন শীল। স্বভাবতই কৌতূহল হল। এ গলি-ও গলিতে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, বৃথাই অবাক হয়েছি! সিসিলিতে সবচেয়ে বেশি মানুষ কথা বলেন ইটালিয়ান ভাষায়, তার পর ইংরেজি; তার পরই সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি বাংলাভাষীরা। ফলে, প্রথম দিন থেকেই বেশ আপন মনে হতে থাকল জায়গাটাকে।
পরের দিন একটা সরু গলি দিয়ে হাঁটছি আমরা দু’জন— তার দু’পাশে অপূর্ব সুন্দর, অথচ ভগ্নপ্রায় সব বাড়ি— চোখে পড়ল, পাঁচ-ছ’জন তরুণী আসছেন উল্টো দিক থেকে। সঙ্গে বাচ্চারা। তাঁরা বাংলায় কথা বলছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, তাঁরা কোন দেশের মানুষ। বললেন, বাংলাদেশ। আমাদের দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে, আমরা স্থানীয় মানুষ নই, অথচ দিব্য বাংলায় কথা বলছি— ওঁরাও কৌতূহলী হলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনারা কি মুসলমান?” একটু ইতস্তত করে আমি উত্তর দিলাম, না, আমরা হিন্দু।
উত্তর শুনে ওঁরা চুপ। নিশ্চয়ই ভাবছিলেন যে, আমরা কী ভাবছি; এ দিকে আমরাও ভাবছি যে, ওঁরা কী ভাবছেন। অস্বস্তিকর নীরবতা ভাঙলাম আমিই। বললাম, ধর্মের ফারাকে কিছু আসে যায় না। আপনারা আর আমরা একই।
আমার উত্তর শুনে ওঁদের মুখে স্বস্তি আর আনন্দের যে আলো ফুটে উঠল, তাতে মনটা ভাল হয়ে যায়। ওঁদের মধ্যে কমবয়সি একটি মেয়ে আমার স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “আমরা সবাই বাঙালি। আমাদের বাড়িতে আপনাদের যেতেই হবে, একটু চা খাওয়াব।” আমি বললাম, কখন? উনি বললেন, “এখনই চলুন।” কাজেই, সেই তরুণী আর তাঁর দুই ফুটফুটে কন্যার সঙ্গে আমি আর অলকাও হাঁটা দিলাম তাঁর বাড়ির উদ্দেশে— সরু গলি অন্ধকার পেরিয়ে তাঁদের দু’কামরার আলোকোজ্জ্বল ফ্ল্যাট। মেয়েটি আমাদের ফল কেটে দিলেন, চা করে দিলেন। ওঁর কাছেই শুনলাম ওঁর স্বামীর কথা। এই শহরেই কাজ করেন, খানিক ক্ষণ পরে বাড়িতে ফিরবেন। মেয়েটি বছর দুয়েক আগে ঢাকা থেকে সিসিলিতে এসেছেন। আমাদের দেখে ওঁর উচ্ছ্বাসে বোঝা যাচ্ছিল, এ পরবাসে হঠাৎ আপন জনের খোঁজ পেয়ে ওঁর সত্যিই আনন্দ হয়েছে। আনন্দ সব সময়ই ছোঁয়াচে, আমরাও খুশি হয়ে গেলাম ওঁর সঙ্গে খানিক ক্ষণ সময় কাটিয়ে।
আমার এই লেখাটা অবশ্য সিসিলির ভ্রমণকাহিনি নয়— সে লেখা অন্য কোনও দিন লিখব— এই লেখাটি লিখছি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাক্রম নিয়ে; সে দেশ এখন যে কঠিন এবং বিপজ্জনক সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছে, সে বিষয়ে। সিসিলিতে মেয়েটির সঙ্গে কাটানো ওই সময়টুকু বাংলাদেশ সম্বন্ধে আমার আশাবাদকে ফের উজ্জীবিত করল।
গত বছর যখন বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকারের পতন হল, তিনি যখন ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলেন, তখন আমার বহু বাংলাদেশি বন্ধুর সঙ্গে আমার মত পুরোপুরি মেলেনি। এই ঘটনায় আমার ভিতরে একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। শেখ হাসিনা তাঁর শাসনকালের প্রথম পর্বে সত্যিই সে দেশের জন্য অনেক কিছু করেছিলেন— দেশে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার দ্রুততর হয়েছিল, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ বলীয়ান হয়েছিল, সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় সরকার সচেতন ছিল। কিন্তু, তাঁর শাসনকালের শেষ দিকে শেখ হাসিনাও পাল্টে গেলেন— কোনও ধরনের সমালোচনাই সহ্য করতে পারতেন না, যে কোনও প্রতিবাদ দমন করতেন বজ্রকঠোর হাতে। তাঁর বহু সমালোচক সম্পূর্ণ বিনা কারণে জেলে পচতে বাধ্য হলেন। ২০২৩-এর শেষে আমি যখন ঢাকায় গিয়েছিলাম, তখন আমার কয়েক জন বন্ধুকে বললাম মুহাম্মদ ইউনূসকে নিমন্ত্রণ করতে। গ্রামীণ ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে তিনি যে কাজ করেছিলেন, আমি তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমি যখন বিশ্ব ব্যাঙ্কের মুখ্য অর্থনীতিবিদ হিসাবে কাজ করছিলাম, সে সময় ইউনূসের সঙ্গে আমার বেশ ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়েছিল। বন্ধুরা জানালেন, ইউনূসকে বাড়িতে ডাকলে তাঁরা মুশকিলে পড়বেন। এই ঘটনায় আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম যে, শেখ হাসিনার বিদায় হওয়ার সময় হয়েছে।
গত বছর অগস্টে যখন ছাত্রদের বিদ্রোহ সফল হল, তাঁরা শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করতে সফল হলেন, তখন ছাত্রনেতারা এবং দেশের সামরিক বাহিনী একটি বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতা নিজেদের হাতে রাখার চেষ্টা করেননি, বরং মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেছিলেন। দেখে ভাল লেগেছিল যে, বাংলাদেশে ক্ষমতার শীর্ষে অধিষ্ঠিত হলেন এক জন ভাল মানুষ।
কিন্তু, গোটা দুনিয়ার বিদ্রোহ ও বিপ্লবের ইতিহাস যদি কোনও একটি শিক্ষা দিয়ে থাকে, তা হল এই যে, শুরুতে যতই উচ্চ আদর্শ থাকুক না কেন, বিপ্লব-পরবর্তী রাষ্ট্রের সম্ভাবনা থাকেই বিপজ্জনক কোনও মোড় ঘোরার। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সেই ঝুঁকি প্রবল। ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীই হোক বা উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী, অথবা নিতান্ত সাঙাততন্ত্র-চালিত ব্যবসায়িক গোষ্ঠী, যে কেউ রাষ্ট্রের রাশ দখল করে নিতে পারে। গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের কথা জানি বলেই আমার মনে হয় যে, তিনি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটতে দেবেন না।
তাই বাংলাদেশে সম্প্রতি যে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাগুলি ঘটছে, তার বিরুদ্ধে ইউনূসকে কঠোর অবস্থান নিতেই হবে। ১২ মে তারিখে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা এমনই একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। শেখ হাসিনাকে আর কখনও শাসনক্ষমতায় দেখতে না চাওয়া এক কথা; কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে দলটির ভূমিকা বিপুল, তাকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা অতি দুর্ভাগ্যজনক। এবং, আমি ব্যক্তিগত ভাবে জানি যে, আওয়ামী লীগের অনেক সমর্থকই শেখ হাসিনার শাসনের শেষ পর্বে তাঁকে নিয়ে অত্যন্ত আশাহত হয়েছিলেন, বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। একই রকম হতাশাজনক ঘটনা হল এ বছর জুন মাসে সিরাজগঞ্জে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৈতৃক বাসভবনে ভাঙচুর চালানো।
বাংলাদেশের প্রথম সারির বুদ্ধিজীবী ও পেশাদারদের অনেককেই যে ভাবে হেনস্থা করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে, জেলে পোরা হয়েছে— তা-ও একই রকম দুঃখজনক। শেখ হাসিনাও তাঁর প্রতিপক্ষের সঙ্গে ঠিক এমন আচরণ করছিলেন। আমি বিশ্বাস করি যে, মুহাম্মদ ইউনূস এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাগুলিকে সমর্থন করেন না। কিন্তু, এমন ঘটনা যাতে আর না ঘটে, তাঁকে তা নিশ্চিত করতে হবে। দেশ যাতে অন্ধকারের পথে চলে না যায়, এই মুহূর্তে সে দিকে নজর দেওয়া দরকার।
আরও একটা কথা মাথায় রাখা দরকার— শেষ কিছু বছর যত খারাপ ঘটনাই ঘটে থাকুক না কেন, বাংলাদেশের কিন্তু প্রভূত উন্নতিও হয়েছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ভারতকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এটা ঠিকই যে, তখন ভারতে আর্থিক বৃদ্ধির হার শ্লথ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু, বাংলাদেশের পক্ষে তা ছিল এক প্রবল সাফল্যের মুহূর্ত— পরিশ্রমের পথে হেঁটে, বহু চেষ্টায় অর্জিত সাফল্য। ২০২৪-এর নাটকীয় পরিবর্তনের পরে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বমঞ্চে স্থান ধরে রাখা সম্ভব— এক গতিশীল গুরুত্বপূর্ণ অর্থব্যবস্থা হয়ে ওঠা সম্ভব, যা একই সঙ্গে আধুনিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক। কিন্তু, তার জন্য প্রতি মুহূর্তে সতর্ক থাকতে হবে— দেশ যেন কোনও ভুল পথে পা না বাড়ায়।
আমি কি বেশি আশাবাদী হচ্ছি? জানি না। তবে, সিসিলিতে ওই বাংলাদেশি মেয়েটির মুখে জ্বলে ওঠা আলো দেখে আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে যে, ঠিক পথে হাঁটার বিচক্ষণতা বাংলাদেশের আছে।
ভূতপূর্ব মুখ্য অর্থনীতিবিদ, বিশ্ব ব্যাঙ্ক; ভূতপূর্ব মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, ভারত সরকার
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে