Asha Workers

বিবাহিত নয়? চাকরি হবে না

কাজে যোগদানের আগেই যাঁরা এমন ‘স্বীকৃতি’ পান, তাঁদের কেউ সন্তানসম্ভবা, কেউ বিধবা, কেউ একলা ছেলেমেয়ে মানুষ করছেন, কেউ বা বৃহৎ পরিবারের ঘরনি।

Advertisement

সন্দীপন নন্দী

শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০২২ ০৫:৫৩
Share:

চাকরির ইন্টারভিউ বোর্ড ডিভোর্স পেপার দেখতে চাইল। বিবাহবিচ্ছিন্ন বা বিধবাতেও আপত্তি নেই, প্রবেশ নিষেধ কেবল অবিবাহিতদের। এমনই শর্ত ‘আশা’ কর্মীদের কাজ পাওয়ার। গ্রামে গ্রামে এই স্বাস্থ্যকর্মীরা মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের সুরক্ষার দায়িত্ব পালন করেন। সেই কাজ পাওয়ার জন্য উত্তরবঙ্গের একটি জেলা সদরে মেয়েরা ফাইলে, খামে, প্লাস্টিকে ভরে নানা কাগজ নিয়ে এসেছেন। তার মধ্যে রয়েছে মাধ্যমিকের মার্কশিটও। মাধ্যমিক ফেল করলেও চাকরি হতে পারে, কিন্তু ফেলের মার্কশিট চাই। অফিসকর্মীরা ফিসফিস করেন, এ যুগেও কেউ মাধ্যমিকে ফেল করে?

Advertisement

কাজে যোগদানের আগেই যাঁরা এমন ‘স্বীকৃতি’ পান, তাঁদের কেউ সন্তানসম্ভবা, কেউ বিধবা, কেউ একলা ছেলেমেয়ে মানুষ করছেন, কেউ বা বৃহৎ পরিবারের ঘরনি। কিন্তু সকলেই চোয়াল চেপে নিজের পায়ে দাঁড়াবেন বলে অফিসের সিঁড়ি ধরে উঠছেন। প্রাপ্তি বলতে এইটুকুই। রাষ্ট্রের দেওয়া পরিষেবার সঙ্গে গ্রামের মেয়েদের যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার কাজ যাঁরা নিতে চান, সরকারি ব্যবস্থার সঙ্গে তাঁদের নিজের সংযোগই খুব ক্ষীণ। অনেকেই জানতেন না, ফেল-করা মার্কশিট লাগবে আশাকর্মী হওয়ার পরীক্ষায় পাশ করতে। ফলে অনেকেই বোর্ডের সেই ছাপা কাগজটি বার করতে পারেননি। হয়তো লজ্জায় কোথাও লুকিয়েছিলেন, হয়তো হতাশায় গুঁজে দিয়েছিলেন উনুনে। তাই আজ ‘অ্যাবসেন্ট’। বার বার ডেকেও পাওয়া গেল না তসমিনা, সিদ্দিকা বা জেসমিনাকে।

টেনেটুনে পাশ-করা মেয়েদের লাইন এগিয়ে যায়। বাইশ-তেইশ পার্সেন্টের নন্দিনী তাঁরা। আজ এক দিনের জন্য হলেও কর্মজীবনের স্বাদ পাচ্ছেন। আজ বহু পুরুষ বাচ্চাকে ভাত খাইয়ে দিলেন, বোতলে জল ভরে স্ত্রীর ব্যাগে ভরে দিলেন, পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে কেউ কেউ হয়তো স্ত্রীর মাথায় পাখার বাতাসও করলেন। এই বা কম কী? পাওনা এটাও। কিন্তু সমাজে মেয়েদের কর্মনিযুক্তি যে কতটা জরুরি, প্রমাণ করে চলল এক দিনের অফিসবেলা। যত্ন, আদর, ভালবাসারা ঘুরঘুর করল কতকগুলো আজব শর্ত-ঝুলানো সরকারি সুতোর চার পাশে।

Advertisement

আচ্ছা, এমন কোনও ইন্টারভিউ আছে, যেখানে পুরুষদের নিয়োগের আগে প্রশ্ন করা হয়, তিনি বিবাহিত, বিপত্নীক বা বিবাহবিচ্ছিন্ন কি না? মেয়েদের এ প্রশ্ন করতে রাষ্ট্রের বাধে না। বিশ্বের সকল রুলবুক মেয়েদের জন্যেই তৈরি। তাই অবিবাহিত মেয়ের স্বেচ্ছায় সমাজসেবা করার আর্জি পেশ হওয়ার আগেই নাকচ হয়ে যায়। সরকারি যুক্তি— এ দেশে বিয়ের পর মেয়েরা চলে যান শ্বশুরঘরে। আশাকর্মীকে এলাকার ‘স্থায়ী বাসিন্দা’ হতে হবে, তাই বিবাহিত হওয়া চাই। কোনও বিধবা আশাকর্মী পুনর্বিবাহ করে নতুন স্বামীর ঘর করতে ডাকজেলা বদলালে বা দিনের পর দিন ধরে বরের মার খাওয়া বেগুনি শাড়ির বৌটি নতুন জীবন পেতে পাশের গ্রামে স্থায়ী বসবাস করতে চাইলে, তাঁদের বদলি চাওয়ার অধিকার থাকবে কি? প্রশ্নের উত্তর ভূভারত খুঁজলেও পাবেন না। আশাকর্মীদের আবার সার্ভিস রুল? এটা ‘সার্ভিস’ নাকি? জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের গাইডলাইন অনুসারে ওই মেয়েরা ‘ভলান্টিয়ার’— স্বেচ্ছাসেবী। মাইনে-করা কর্মী নন। তাই সাপ্তাহিক ছুটি নেই। ন্যূনতম মজুরিও নেই।

আশাকর্মীদের নিয়োগরত রাষ্ট্র আর বাংলা টিভি সিরিয়ালে প্রদর্শিত পরিবার, দুটো যেন একই মুদ্রার দু’পিঠ। বিয়ে না হলে কোনও মেয়ের প্রবেশ নিষেধ, আর ঢোকার পরে কেবলই স্বেচ্ছাশ্রম। বরং কথায় কথায় বার করে দেওয়ার হুমকি, সর্বদা অযোগ্য প্রতিপন্ন করার চেষ্টা। আশাকর্মীর কাজের কোনও নির্দিষ্ট পরিমাণ নেই, সময়সীমা নেই। কাজের উপর কাজ, ডিউটির উপর ডিউটি চাপানো হতে থাকে। চব্বিশ ঘণ্টা মোবাইলে সাড়া দিতে হবে তাঁকে, ফাঁকি চলবে না। ফোনের রিচার্জের জন্য বরাদ্দ কত? একশো টাকা। বেগুনি শাড়ি ‘মাস্ট’, জলকাদায় সাইকেলে চাপলেও চুড়িদার ‘নট অ্যালাউড’।

দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে আয়রন ট্যাবলেট বিলি করে, শিশুর টিকাবৃত্ত সম্পূর্ণ করে, হাসপাতালে নিরাপদে প্রসূতির সন্তানপ্রসবের সুবন্দোবস্ত করেও বকেয়া ভাতার জন্য ডেপুটেশন দিতে হয় তাঁদের। ভাতার হিসাবে স্বচ্ছতা নেই। আলতায়-লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে, কাজ হারানোর হুমকি মাথায় নিয়ে, ওই মেয়েরা হাঁটেন শহরের রাস্তায়। গ্রামের মেয়েদের মিছিল-সমাবেশ লজ্জিত করে স্পর্ধিত মহানগরকেও— যাঁদের উপর গর্ভবতীদের স্বাস্থ্যরক্ষার ভার, সেই আশাকর্মীদের দাবি, ‘মাতৃত্বের ছুটি চাই’।

চাকরির পরীক্ষার দিন থেকেই কর্মজীবনের এই ভবিষ্যতের আভাস মেলে। এক জন বলেন, “ফ্যান ছাড়া দাঁড়ানো আর কী কষ্ট।” বাচ্চাকে বেঞ্চে বসিয়ে হোম টাস্ক দিয়ে পরীক্ষা দিতে ঢুকলেন মা। এক বছর কুড়ির বধূ বরের বুদ্ধিতে পরীক্ষা দিতে এসে ‘আন্ডারএজ ম্যারেজ’-এর জন্য শ্লেষোক্তি শোনেন। এরই মাঝে কান্নার রোল। মাধ্যমিকে প্রথম বিভাগ পেয়েছিলেন, কিন্তু প্রাক্তন স্বামী সব নথি নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছেন। অনুনয় কাজে আসে না। ভরদুপুরে চলতে থাকে ইন্টারভিউ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন