সম্পাদকীয় ২

কাহার পরীক্ষা

দোষী সব্যস্ত না হইলে সন্দেহভাজনকে নির্দোষ বলিয়া ধরিয়া লয় ভারতের আইন। কিন্তু সমাজ অপরাধের সম্ভাবনাতেই তাহাকে শাস্তি দিতে দ্বিধা করে না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০১৭ ০০:৩৬
Share:

দোষী সব্যস্ত না হইলে সন্দেহভাজনকে নির্দোষ বলিয়া ধরিয়া লয় ভারতের আইন। কিন্তু সমাজ অপরাধের সম্ভাবনাতেই তাহাকে শাস্তি দিতে দ্বিধা করে না। সম্প্রতি পরীক্ষার্থীদের সহিত তাহাই ঘটিল কেরলে। মেডিক্যালের সর্বভারতীয় প্রবেশিকা ‘নিট’ পরীক্ষায় টোকাটুকি হইতে পারে, সেই আশঙ্কায় এক ছাত্রীকে অন্তর্বাস খুলিতে বাধ্য করিলেন পরীক্ষকরা। ক্ষমতার এমন অপপ্রয়োগের জন্য চার শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রাথমিক ভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হইয়াছে। কিন্তু তাহাতেই প্রশ্নটি শেষ হইয়া যায় না। যে মানসিকতার বশে শিক্ষক ছাত্র বা পরীক্ষার্থীর উপর যে কোনও ভীতিপ্রদ, লজ্জাজনক ব্যবস্থা চাপাইয়া দিতে পারেন, প্রশ্ন সেই মনোভাবটি লইয়া। কেরলের ওই শিক্ষকেরা কেবল ‘বাড়াবাড়ি’ করিয়া ফেলিয়াছেন ভাবিলে ভুল হইবে। কেবল সন্দেহের বশে পরীক্ষার্থী তরুণীকে পীড়াদায়ক আদেশ দিতে যে তাঁহারা দ্বিধা করেন নাই, ইহাই শাস্তিযোগ্য ও নিন্দনীয়। শিক্ষক বা অভিভাবকের স্থান অধিকার করিলে ছাত্রছাত্রী বা সন্তানদের অসম্মান করিবার, লজ্জা দিবার অধিকার জন্মাইয়া যায় না। কিশোর ও তরুণদের আত্মসম্মান, শারীরিক ও মানসিক কল্যাণ, আকাঙ্ক্ষা ও উচ্চাশাকে আঘাত না করিয়াই শৃঙ্খলা বজায় রাখা প্রয়োজন। কাজটি সহজ নহে। বিশেষত ভারতে শিশুকে ভয় দেখাইয়া বশে রাখিবার একটি দীর্ঘ রীতি রহিয়াছে। শিক্ষার অধিকার আইন স্কুলে দৈহিক শাস্তি বন্ধ করিলেও, সেই রীতির ভূত তাড়াইতে পারে নাই। ফলে সহপাঠীদের সম্মুখে অপদস্থ, অপমানিত হইয়া বহু শিশু স্কুল ত্যাগ করে, আত্মহত্যাও করে। আরও অনেক তরুণ মন অন্যায় আঘাতের ক্ষতচিহ্ন নীরবে বহন করিতেছে। পরীক্ষার্থীকে বিপন্ন করাও কি দুর্নীতি নহে?

Advertisement

শিক্ষকরা অবাধে পরীক্ষায় টোকাটুকি করিতে দেখিয়াও অবশ্যই চোখ বুজিয়া থাকিবেন না, কিন্তু পরীক্ষাকেন্দ্রে দুর্নীতির সম্মুখে শিক্ষকদের প্রতিক্রিয়াগুলিও বিচিত্র। কখনও গণটোকাটুকি হইলেও তাঁহারা নির্বিকার। সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরায় বহিরাগতদের ‘সহায়তা’র ছবি উঠিয়া যায়, অথচ প্রহরারত শিক্ষক নীরব। আবার কখনও অতি সামান্য বিচ্যুতিতে, এমনকী বিচ্যুতির আশঙ্কাতেই তাঁহারা নির্দয় হইয়া ওঠেন। হয়তো নিজের প্রতি ঝুঁকি বিচার করিয়াও শিক্ষকরা পদক্ষেপ করেন।

টোকাটুকির সমস্যার শিকড় ভ্রান্ত পরীক্ষাব্যবস্থায়। আমাদের শিক্ষাকর্তারা ভুলিয়াছেন, স্বচ্ছ, দুর্নীতিহীন পরীক্ষা নিশ্চিত করিতে হইলে চাই পরীক্ষাব্যবস্থার সংস্কার। পশ্চিমের দেশগুলিতে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রশ্নগুলিই এমন ভাবে রাখা হয়, যাহাতে বিষয়টি না বুঝিয়া থাকিলে উত্তর দেওয়া অসম্ভব। স্মরণশক্তির নহে, বিচারবুদ্ধির পরীক্ষা। বিশেষত বৈদ্যুতিন মাধ্যমে পরীক্ষায় উত্তর দিবার সময়ও মাপা হয়। বাহিরের সহায়তার অপেক্ষা করিলে সময় বহিয়া যাইতে বাধ্য। আবার, প্রশ্নের তালিকাও নির্দিষ্ট নহে। ছাত্রের উত্তরের মান অনুসারে পরবর্তী প্রশ্ন নির্ধারিত হইয়া যায়। এই ব্যবস্থায় প্রশ্ন ফাঁসের, টোকাটুকির ভয় নাই, নানা কেন্দ্রে সংবৎসর পরীক্ষা চলিতে পারে, খরচ এবং ব্যবস্থাপনার সমস্যাও কমিবে। সর্বোপরি, ইহা বাস্তবিক মেধা ও বুদ্ধির পরীক্ষা হইবে। পরীক্ষার্থীদের নাকাল না করিয়া পরীক্ষাব্যবস্থার সংস্কার করুক সরকার।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন