প্রকাশ জাভড়েকরের সুখনিদ্রা দৃশ্যত ফলপ্রসূ হইয়াছে। সিবিএসই-র প্রশ্ন ফাঁস হওয়ায় তাঁহার ঘুম আসিতেছিল না বলিয়া মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী জানাইয়াছিলেন। তাহার পর, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষোভের পবিত্র আগুন আসিয়া সিবিএসই-র যাবতীয় দুর্নীতিকে ভস্ম করিয়া দিল। জাভড়েকরও নিশ্চিন্তে ঘুমাইয়া পড়িলেন। ঘুম ভাঙিতেই তিনি জানাইয়া দিলেন, দশম শ্রেণির গণিতের আর পরীক্ষা হইবে না। কারণ, ফাঁস হওয়া প্রশ্ন নাকি বেশি ছড়ায় নাই। তিনি কী ভাবে জানিলেন, মন্ত্রী বলেন নাই। অনুমান করা চলে, ‘তথ্য’টি স্বপ্নাদ্য। মন্ত্রীর স্বপ্ন বলিয়া কথা! প্রধানমন্ত্রীও নিশ্চয় শান্ত হইয়াছেন। প্রশ্ন যে আদৌ ফাঁস হয় নাই, যেটুকু যাহা ছড়াইয়াছিল, তাহা নিতান্তই ইউপিএ জমানার পাপ, ফের পরীক্ষা না লইবার সিদ্ধান্তটিই কি এই কথার অকাট্য প্রমাণ নহে? অতএব, শান্তিকল্যাণ। ছাত্ররাও খুশি, ছুটি মাটি হইবে না। অভিভাবকরাও খুশি, ফের পরীক্ষার ঝামেলা থাকিল না। দীনদয়াল উপাধ্যায় মার্গের পাঁচতারা সদর দফতরেও নিশ্চয় স্বস্তির হাওয়া— নির্বাচনের আগের বৎসর ফের পরীক্ষা লইবার অপ্রীতিকর সিদ্ধান্তটি এড়ানো গেল। প্রধানমন্ত্রী-সহ অন্যরা ফের ঘুমাইয়া পড়িতে পারেন।
ফের অঙ্ক পরীক্ষা না লইবার সিদ্ধান্তটি যে আঠারো আনা রাজনৈতিক, তাহা সন্দেহাতীত। দ্বাদশ শ্রেণির অর্থনীতি এক কথা, দশম শ্রেণির গণিত আর এক। দশম শ্রেণিতে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ষোলো লক্ষ, এবং তাহাদের সিংহভাগেরই বিষয় হিসাবে অঙ্ক আছে। ফলে, দেশ জুড়িয়া ফের অঙ্ক পরীক্ষা লইলে বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রীর উপর তাহার প্রভাব পড়িত। তাহাদের এখনও ভোট নাই, কিন্তু পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যদের বিলক্ষণ আছে। যাঁহাদের বাড়িতে এই বৎসরের পরীক্ষার্থী নাই, সিদ্ধান্তটি তাঁহাদেরও বিচলিত করিত। ফের পরীক্ষা লইলে এই বিপুল জনগোষ্ঠীর অধিকাংশকেই চটাইতে হয়। নির্বাচনের দোরগোড়ায় দাঁড়াইয়া সেই সাহস যে কেন্দ্রীয় সরকারের নাই, কেবলমাত্র দিল্লি আর হরিয়ানায় পুনঃপরীক্ষার প্রাথমিক সিদ্ধান্তটিতেই তাহা বোঝা গিয়াছিল। কয়েক দিনের মধ্যেই পরীক্ষার সম্ভাবনাটি নির্মূল করিয়া জাভড়েকর নিজেদের সাহসের অভাবকে সন্দেহাতীত করিয়া দিলেন। প্রশ্ন ফাঁস হইয়াছে, সর্ব স্তরে তাহা মানিয়া লওয়ার পরও ফের পরীক্ষা না লইবার সিদ্ধান্তটি কার্যত নজিরবিহীন। রাজনীতির হাতে শিক্ষাব্যবস্থার হেনস্থা এই দেশে নূতন নহে— এই সরকারের আমলেও তাহাই প্রথা। কিন্তু, সেই প্রেক্ষিতেও, বর্তমান সিদ্ধান্তটির মধ্যে যে নির্লজ্জ রাজনৈতিক সুবিধাবাদ রহিয়াছে, তাহা অভূতপূর্ব। এবং, বিপজ্জনক।
প্রশ্ন ফাঁস হইবার পরও ফের পরীক্ষা না লইবার সিদ্ধান্তটি আপত্তিকর কেন, সভ্য সমাজে তাহা ব্যাখ্যা করিবার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু, বিজেপির জমানায় ভাঙিয়া বলা ভাল। বোর্ডের পরীক্ষা নামক বস্তুটির যদি একটি মাত্র তাৎপর্য থাকে, তাহা হইল, পরীক্ষাটি সব ছাত্রের নিরপেক্ষ মূল্যায়ন করে। কে কতখানি প্রস্তুত, নম্বরের মাপকাঠিতে তাহার বিচার হয়। ফাঁস হওয়া প্রশ্ন যদি একটি মাত্র ছাত্রের হাতেও পৌঁছয়, তাহা হইলেও আর পরীক্ষার কোনও অর্থ থাকে না, কারণ অন্তত সেই ছাত্রটির প্রকৃত মূল্যায়ন এই পরীক্ষায় হয় না। অতএব, প্রশ্ন ফাঁস হইলে পরীক্ষা বাতিল করিয়া নূতন পরীক্ষার ব্যবস্থা করিতে হইবে, এই নীতির কোনও নড়চ়ড় নাই। পরীক্ষা না লইবার সিদ্ধান্তটি কেন বিপজ্জনক? কারণ, এক বার যদি ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি হইতে সরিয়া আসা হয়, তবে ভবিষ্যতে প্রশ্ন ফাঁস হইলেই প্রশ্ন উঠিবে, কতখানি ছড়াইয়াছে? তাহা কি পরীক্ষা বাতিল করিবার জন্য যথেষ্ট? এবং, এই প্রশ্নের উত্তর কী হইবে, অনুমান করা চলে। পরীক্ষা ব্যবস্থাটিই ইহার ফলে অর্থহীন হইয়া যাইবে। জাভড়েকররা সেই বিপর্যয়েরই দরজা খুলিতেছেন।