সম্পাদকীয় ২

বহিষ্কারের সাহস

ওয়াইনস্টেইন ব্যতিক্রম হইলেন। ইহার কারণ তিনি নিজে নহেন, তাঁহার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলিও নয়। কারণটি লুকাইয়া আছে বৃহৎ প্রেক্ষাপটের মধ্যে, যাহার অপর নাম সময়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০১৭ ০০:১৪
Share:

আট হাজার চার শত সদস্যের মধ্য হইতে তাঁহার নামটি কাটা পড়িল। চলচ্চিত্র প্রযোজক হার্ভি ওয়াইনস্টেইনকে যে ভাবে হলিউডের অস্কার অ্যাকেডমি অব মোশন পিকচার্স তাহার সদস্য তালিকা হইতে সরাইয়া দিল, তাহা এক কথায় অদৃষ্টপূর্ব। তাঁহার বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার অভিযোগ ওঠাতেই এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। ব্যাপারটি ফেলনা নয়। শেক্সপিয়র ইন লাভ, দি ইংলিশ পেশেন্ট, শিকাগো, দ্য কিং’স স্পিচ, দি আর্টিস্ট— একের পর এক দুনিয়া-কাঁপানো সিনেমা যিনি চলচ্চিত্র মহলকে উপহার দিয়া রুপালি জগতের মহীরুহে পরিণত হইয়াছেন, তাঁহার বিষয়ে এমন একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সহজ ছিল না। ঠিকই, তাঁহার বিরুদ্ধে এখন বিপুল জনমত, কেট উইনস্লেট-এর মতো নামী তারকাও সরাসরি তাঁহার সমালোচনা করিয়াছেন। তবু নাম কাটিয়া দিবার মধ্যে যে দ্ব্যর্থহীনতার সাহস, তাহা সহজ কথা নয়। একটি বৃহৎ সামাজিক দায়বদ্ধতার পরিচয় দিল অ্যাকাডেমি: ইতিহাসে প্রথম বার। ইতিপূর্বে মাত্র এক জনকেই বিতাড়িত করা হইয়াছিল, গুরুতর নিয়মভঙ্গের অভিযোগে। এই বারের অভিযোগটি কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক নয়, ব্যক্তি-চারিত্রিক। নারী-নিগ্রহের অভিযোগ যে শেষ পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক, তাহারই প্রমাণ এই পদক্ষেপে।

Advertisement

বলিলে ভুল হইবে না, ইহার মাধ্যমে হলিউড একটি নূতন পর্বে উন্নীত হইল। বহু যৌন নিগ্রহের ঘটনা, বহু ছোটবড় নায়িকা ও মহিলা কর্মীর আনা বিভিন্ন অভিযোগ, বহু পরিচালক কিংবা প্রযোজকের ব্যক্তিগত জীবনের যৌন ব্যাভিচার ও কদাচারের ঘটনার প্রকাশ— এত দিন এ সব কিছু কাল মশলাদার সংবাদ হইয়া থাকিবার পর অভ্রান্ত নিয়মে অস্তাচলগামী হইত। উজ্জ্বল বিভায় জ্বলিতে থাকিত খ্যাতি ও ক্ষমতার মহিমা। মনে পড়িতে পারে, রোমান পোলানস্কি কী ভাবে ত্রয়োদশবর্ষীয়া বালিকাকে যৌন হেনস্তার জন্য অভিযুক্ত হইয়াছিলেন, বিল কসবির বিরুদ্ধেও যৌন অভিযোগ উঠিয়াছিল। কিন্তু অ্যাকাডেমির সদস্য পদ হইতে কাহাকেও সরানো হয় নাই। উডি অ্যালেন-এর বিরুদ্ধে তাঁহার সৎ-কন্যার সহিত যৌন সম্পর্ক রাখিবার অভিযোগ ছিল: তিনিও শাস্তি পান নাই। পুলিশ তদন্ত চোখের আড়ালে মিলাইয়া গিয়াছে, সামাজিক ছিছিক্কার কালের স্রোতে তলাইয়া গিয়াছে।

ওয়াইনস্টেইন ব্যতিক্রম হইলেন। ইহার কারণ তিনি নিজে নহেন, তাঁহার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলিও নয়। কারণটি লুকাইয়া আছে বৃহৎ প্রেক্ষাপটের মধ্যে, যাহার অপর নাম সময়। সময় ও যুগ ইতিমধ্যে পাল্টাইয়া গিয়াছে। যৌন অভিযোগ লইয়া সংবেদনশীলতা অনেকগুণ বাড়িয়াছে। আরও বেশি বাড়িয়াছে সংবাদমাধ্যমের সক্রিয়তা। প্রচারমাধ্যমের বহুত্ব ও সর্বগামিত্ব আজ এত বেশি যে তাহাকে ভুল বুঝাইয়া ঘুম পাড়াইয়া রাখা অসম্ভব। সঙ্গে আছে মহিলাদের লড়িয়া যাইবার সাহসিকতা: এক দশক আগেও নিজের যৌন হেনস্তার কথা নিজে বলিবার সাহস মেয়েদের কাছে সহজপ্রাপ্য ছিল না। দিনকাল পাল্টাইয়াছে। এখন প্রশ্ন এই যে, পুরাতন অপরাধীরাও কি ওয়াইনস্টেইনের ভবিতব্য দেখিয়া শঙ্কিত বোধ করিবেন? এই প্রশ্ন কি উঠিবে না যে, একই অপরাধে অমুকের নাম কাটা গেলে তমুকরা এখনও বহাল তবিয়তে থাকেন কী করিয়া? কৌতূহল রহিয়া গেল।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন