advertisements

বিজ্ঞাপনের কারসাজি আর নয়

নানা পণ্য ও পরিষেবার গুণাগুণ ও কার্যকারিতা নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে যে সব বিজ্ঞাপন উপভোক্তাকে আকৃষ্ট করে, তার সবই কি অসত্য?

Advertisement

তূর্য বাইন

শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২১ ২৩:০১
Share:

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় সম্প্রতি হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হওয়ায় দেশ উদ্বিগ্ন, তাঁকে দেখতে হাসপাতালে দল-মত নির্বিশেষে রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রী থেকে শুরু করে শুভানুধ্যায়ীদের ঢল নেমেছে। হাসপাতাল থেকে ছাড়াও পেয়েছেন, কিন্তু তাঁর শারীরিক অবস্থার দ্রুত উন্নতির পরেও যে মানুষটির বিপন্নতা কাটেনি, তাঁর নাম আদানি উইলমার। বেশ কিছু দিন ধরে বহুল প্রচারিত এক বিজ্ঞাপনে ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেট অধিনায়ক এক বিশেষ ব্র্যান্ডের তেলকে হৃৎপিণ্ডের স্বাস্থ্য-সহায়ক বলে দাবি করেছিলেন। তেলটির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর স্বয়ং হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর সমাজমাধ্যম ওই বিজ্ঞাপন সম্পর্কে তির্যক মন্তব্য ও ব্যঙ্গচিত্রে ছেয়ে গেছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে বিজ্ঞাপনটির সম্প্রচার স্থগিত করা হয়েছে।

Advertisement

পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম উপভোক্তার দেশ ভারতে এই ঘটনা সকলকে এক প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। নানা পণ্য ও পরিষেবার গুণাগুণ ও কার্যকারিতা নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে যে সব বিজ্ঞাপন উপভোক্তাকে আকৃষ্ট করে, তার সবই কি অসত্য?

এ প্রসঙ্গে আরও দু’টো ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। পুরুষদের ত্বকের রং ফর্সা করার দাবি নিয়ে বাজারে এসেছিল একটা ক্রিম, ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর ছিলেন শাহরুখ খান। বিজ্ঞাপনে দাবি, ক্রিমটি মাত্র পনেরো দিন ব্যবহারেই পুরুষদের ত্বক ফর্সা হবে। ২০১২-র ৮ অক্টোবর রোহিণীর বাসিন্দা নিখিল জৈন ওই ক্রিম কিনে তিন সপ্তাহ ব্যবহারের পরেও ত্বকের রঙে কোনও উন্নতি না দেখে দিল্লির এক ক্রেতা আদালতে অভিযোগ করেন। আদালত সব দিক বিচার করে ক্ষতিপূরণ বাবদ নিখিলকে দশ হাজার এবং উপভোক্তা কল্যাণ তহবিলে পনেরো লক্ষ টাকা দেওয়ার জন্যে প্রস্তুতকারক সংস্থাকে নির্দেশ দেয়। বিজ্ঞাপনটির সম্প্রচারেও নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

Advertisement

দ্বিতীয় ঘটনাটি কেরলের। বিজ্ঞাপন দেখে ফ্রান্সিস ভেড়াক্কার ৩৭৬ টাকা দিয়ে একটি সংস্থার তৈরি ‘টাকে চুল গজানোর তেল’ কিনে ব্যবহার করতে শুরু করেন। পরে কোনও ফল না পেয়ে তিনি তেলটির প্রস্তুতকারক সংস্থা এবং বিজ্ঞাপনে যাঁকে দেখা গিয়েছিল (আইনি ভাষায় ‘এনডোর্সার’) সেই অভিনেতা অনুপ মেননের বিরুদ্ধে ত্রিশূরের জেলা ক্রেতা আদালতে পাঁচ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে অভিযোগ করেন। আদালতে অনুপ মেনন স্বীকার করেন, তেলটির জন্যে তিনি বিজ্ঞাপন করেছেন বটে, তবে তা নিজে কখনও ব্যবহার করেননি। সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট ক্রেতা আদালত ওই কেশ তেল প্রস্তুতকারক সংস্থা এবং অনুপ মেনন, উভয়কেই দশ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।

ভারতবর্ষের ক্রেতা আদালতগুলিতে প্রতি দিন এমন অজস্র অভিযোগ দায়ের হচ্ছে, নিষ্পত্তিও। ওপরের দু’টো ঘটনা থেকে ক্রেতা সুরক্ষা আইনের ক্রমবিবর্তনের একটা চিত্র পাওয়া যায়। এখন কোনও জিনিস বা পরিষেবা সম্পর্কে বিজ্ঞাপনে দাবি করা গুণ বা কার্যকারিতা অসত্য প্রমাণিত হলে আগের মতো শুধু প্রস্তুতকারক বা বিপণনকারী নন, তার সঙ্গে যিনি ওই পণ্যের বিজ্ঞাপনের মুখ, সেই ‘এনডোর্সার’ও দায়বদ্ধ। এই পরিবর্তন এসেছে গত ২০ জুলাই, ২০২০ তারিখে কার্যকর হওয়া ‘ক্রেতা সুরক্ষা আইন ২০১৯’-এর হাত ধরে। নতুন আইনে উপভোক্তা স্বার্থ-সহায়ক অনেকগুলি নতুন ধারা সংযোজিত হয়েছে। পরিবর্তন আনা হয়েছে ক্রেতা আদালতের এক্তিয়ারেও। এখন এক জন উপভোক্তা ভারতবর্ষের যেখান থেকেই জিনিস বা পরিষেবা নেন না কেন, অভিযোগ জানাতে পারবেন তাঁর নিকটবর্তী আদালতেই। কুড়ি লক্ষ টাকার পরিবর্তে এক কোটি টাকা মূল্য-সম্বলিত বিরোধের নিষ্পত্তি করতে পারবে জেলা আদালত, আর রাজ্য কমিশনের এক্তিয়ার দশ কোটি টাকা পর্যন্ত। অনলাইন কেনাকাটা থেকে শুরু করে ‘ডিরেক্ট সেলিং’–এর মাধ্যমে বিকিকিনিও এই আইনের অন্তর্ভুক্ত।

উপভোক্তা ও সাধারণ নাগরিককে সুরক্ষা দিতে ২০২০ সালের ২৪ জুলাই ‘সেন্ট্রাল কনজ়িউমার প্রোটেকশন অথরিটি’ বা সংক্ষেপে ‘সেন্ট্রাল অথরিটি’ গঠিত হয়েছে। উপভোক্তা-অধিকার লঙ্ঘন, অন্যায্য বাণিজ্য অনুশীলন কিংবা মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সমষ্টিগত ভাবে উপভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেন্ট্রাল অথরিটি স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে তদন্ত করে এর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, বিজ্ঞাপনদাতা, এমনকি বিজ্ঞাপক বা ‘এনডোর্সার’কেও শাস্তি দিতে পারবে।

সেন্ট্রাল অথরিটি-র হয়ে তদন্তের জন্যে তদন্তকারী শাখাও গঠিত হয়েছে। এই শাখার ডিরেক্টর জেনারেল নিযুক্ত হয়েছেন বুরো অব ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড (বিআইএস)-এর ডিরেক্টর জেনারেল। বিআইএস-এর সমস্ত রিজিয়োনাল ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল, ব্রাঞ্চ অফিসের সার্টিফিকেশনের প্রধান এবং ল্যাবরেটরির প্রধানরা তদন্তের ক্ষমতা পেয়েছেন। শুরু হয়েছে আধিকারিকদের প্রশিক্ষণ-পর্ব। সেন্ট্রাল অথরিটি চাইলে নিজ এলাকায় তদন্ত করবেন জেলা শাসকরাও। পণ্য বা পরিষেবার গুণমান সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে বিজ্ঞাপনে মুখ দেখানোর দিন সম্ভবত শেষ হতে চলেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন