Narendra Modi

নায়ক?

সিপিআই-এর বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আদর্শ ও হিন্দু মহাসভার বিশ্বব্যাপী মুসলিম-বিরোধিতার আদর্শের মধ্যে বহু মহাসাগরের তফাত। সুতরাং, ২০২০ সালে বাঙালির প্রাণে যতই বিপুল ব্যথার তরঙ্গ উঠুক, ইতিহাসের খাতিরে মানিতে হইবে— ব্রিটিশের হাড়-জ্বালাইয়া দেওয়া আইএনএ-শিরোমণি নেতাজির পরিবর্তে ব্রিটিশ-মিত্র শ্যামাপ্রসাদই কলিকাতা বন্দরের যোগ্যতর উত্তরাধিকারী!  

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০২০ ০০:০৫
Share:

তবু রঙ্গে ভরা। গত সপ্তাহে বঙ্গদেশে আসিয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যে কাজটি করিয়া গেলেন, তাহা নানা অর্থেই ঐতিহাসিক— এবং রঙ্গময়। তিনি কলিকাতা বন্দরের একটি নূতন নাম দিয়া গেলেন, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বন্দর। এত দিনকার নেতাজি সুভাষচন্দ্রের নামাঙ্কিত ড্রাই ডকটি ইহার ফলে উপেক্ষণীয় হইয়া গেল কি না, তাহা বলা মুশকিল। তবে, সত্য যে, এত দিন অবধি বাংলার বন্দরটিতে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুই ছিলেন একমাত্র জাতীয় নায়ক। এই বার তাঁহার মাথার উপর ছাতার মতো আর এক ‘নায়ক’কে বসাইয়া দেওয়া হইল— শ্যামাপ্রসাদ। উদ্ধৃতিচিহ্নটির ব্যবহার কেন, তাহা নিশ্চয় কিছু ব্যাখ্যা দাবি করে। কিন্তু সেই ব্যাখ্যায় যাইবার পূর্বে একটি কথা বলা দরকার। সত্য বলিতে, কলিকাতা বন্দরের সহিত যদি কাহারও নাম জুড়িতেই হয়, তাহা হইলে সুভাষচন্দ্র অপেক্ষা শ্যামাপ্রসাদই যোগ্যতর!

Advertisement

যখন-তখন শহর, রাস্তা, স্টেশন, বন্দর ইত্যাদির নাম পাল্টাইয়া রাজনীতি করিবার অভ্যাসটি মূর্খোচিত এবং ইতিহাসবোধবিবর্জিত। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোদীর আমলে বিজেপির একটি বিশেষ গোঁয়ার্তুমি দাঁড়াইয়া গিয়াছে এই নাম-রাজনীতি, মোদীর কলিকাতা-সফরেও তাহাই ঘটিল। তবে কিনা এই অবকাশে তাঁহার অভ্যাসটির সমালোচনার সহিত একটু রঙ্গ না মিশাইলেও চলিতেছে না। কেননা, ইতিহাস সাক্ষী, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যখন কলিকাতা বন্দর ব্রিটিশ রাজের নিকট অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, এমনকি ভারতের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি হইয়া উঠিয়াছিল— তখনকার কথা বিবেচনা করিলে বলিতে হয় যে, কলিকাতা বন্দরের শিরোভূষণটি ব্রিটিশ শক্তির কোনও বন্ধুর ভাগ্যেই জোটা উচিত, ব্রিটিশ শক্তির শত্রুর ভাগ্যে নহে! আর কে না জানে, দেশের স্বাধীনতা-লক্ষ্যে একচক্ষু হরিণের মতো ধাবমান বাঙালি নেতা সুভাষচন্দ্র বসু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে হইয়া উঠিয়াছিলেন ইংল্যান্ডের ‘হিজ় ম্যাজেস্টি’র অন্যতম প্রধান মাথাব্যথা। যুদ্ধ চলাকালীন জাপানের টুঁটি টিপিবার জন্য এবং তন্মাধ্যমে সুভাষকে শিক্ষা দিবার জন্য কলিকাতা বন্দর ছিল বিরাট ভরসাস্থল। ও দিকে, পাশাপাশি, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সেই সময় ছিলেন হিন্দু মহাসভার একচ্ছত্র বাঙালি নেতা। তাঁহার দল ছিল কায়মনোবাক্যে ব্রিটিশ রাজের সহকারী, সহচারী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন কংগ্রেস-আহূত যে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন, তাহাতেও মিত্রভাবাপন্ন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের দল অংশ লয় নাই, বরং ঔপনিবেশিক শক্তির পাশে দাঁড়াইয়া তাহাদের হাত শক্ত করিয়াছিল। একই কাজ করিয়াছিল ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিও, কিন্তু রাজনীতি ও সমাজবোধের দিক দিয়া দুই পক্ষের তুলনা চলে না। সিপিআই-এর বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আদর্শ ও হিন্দু মহাসভার বিশ্বব্যাপী মুসলিম-বিরোধিতার আদর্শের মধ্যে বহু মহাসাগরের তফাত। সুতরাং, ২০২০ সালে বাঙালির প্রাণে যতই বিপুল ব্যথার তরঙ্গ উঠুক, ইতিহাসের খাতিরে মানিতে হইবে— ব্রিটিশের হাড়-জ্বালাইয়া দেওয়া আইএনএ-শিরোমণি নেতাজির পরিবর্তে ব্রিটিশ-মিত্র শ্যামাপ্রসাদই কলিকাতা বন্দরের যোগ্যতর উত্তরাধিকারী!

এ বার আসা যাক উদ্ধৃতিচিহ্নের প্রসঙ্গে। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে বাঙালি নায়ক হিসাবে উদ্ধৃতি-চিহ্নের বাহিরে না ভিতরে রাখা উচিত, বাঙালিকেই তাহা স্থির করিতে হইবে। ইতিহাসের তথ্য লইয়া তর্কাতর্কির শেষ নাই, এই সম্পাদকীয়ের পরিসরে তাহাতে না ঢুকিলেও চলিবে। তবে তাঁহার পক্ষে-বিপক্ষে সকলেই কিন্তু এক বাক্যে স্বীকার করিবেন যে, শ্যামাপ্রসাদের রাজনীতির কতগুলি বিশেষত্ব ছিল। তিনি স্বঘোষিত ভাবে হিন্দু বাঙালির নেতা ছিলেন, মুসলিম বাঙালি বিষয়ে তাঁহার ঘৃণা ও দ্বেষ ছিল প্রকট। তিনি নিজেকে হিন্দু উচ্চবর্ণের প্রতিনিধি ভাবিতেন, মহাত্মা গাঁধী ও কংগ্রেসের সহিত তাঁহার বিরোধ উনিশশো ত্রিশ দশকে সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারার পর হইতেই তীক্ষ্ণ ও গভীর। আর একটি সর্বজনমান্য তথ্য— ১৯৪৭ সালের বঙ্গবিভাগ ও দেশভাগে তাঁহার পূর্ণ সমর্থন ও সক্রিয় প্রচার। ‘বঙ্গের পাকিস্তানিকরণ’ লইয়া তিনি সেই সময়ে যত উদ্বেল ছিলেন, এবং তাহা ঠেকাইতে দেশভাগে যে ভাবে উঠিয়া-পড়িয়া লাগিয়াছিলেন, কম নেতাই তাহার তুল্য দাবি রাখিতে পারেন। একবিংশ শতকের বাঙালির ‘নায়ক’ হইতে গেলে এই সব তথ্য তাঁহার দোষ না গুণ, কোন হিসাবে বিবেচিত হইবে— বাঙালির উপরেই রহিল সেই ভার।

Advertisement

যৎকিঞ্চিৎ:

ধোনিকে ভারতীয় ক্রিকেট দলের সেন্ট্রাল কন্ট্র্যাক্টের বাইরে রাখা হল বলে, সোশ্যাল মিডিয়া ও সাধারণ বাস্তবে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু স্বয়ং ধোনি? কোনও উচ্চবাচ্য নেই। হ্যাঁ নয়, না নয়, টুইট নয়, ব্যঙ্গ নয়। এই হল প্রকৃত কুলীন ‘কুল’ত্ব। মাঠের মতো, জীবনেও, নির্বিকার। সুখে বিগতস্পৃহ, দুঃখে অনুদ্বিগ্নমনা। নিজের মতো চলেন, কাউকে কৈফিয়ত দেন না, বিপদে পড়লে ডাকতেও যান না। প্রাচীন ঋষিদের থেকে উনি শিখেছেন, না কি তাঁর থেকে ভাবী রোবটেরা শিখবেন, জল্পনা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন