আঁধারহরণ: শব্দ আর ধোঁয়ার তাণ্ডব নয়, দীপাবলি হোক আলোকমালিকা দিয়ে অশুভ বিনাশের় উৎসব
মানুষ আগে নিজেই ভয় পেয়েছিল। আগুনের তাপে বাঁশের গাঁটে আটকে থাকা হাওয়া সশব্দে ফেটে পড়ায় আতঙ্কিত হয়েছিল জীবজগৎও। তার পর মানুষ নিজের ভয় পাওয়ার পুঁজিটাকেই বিনিয়োগ করে দিল অশুভ শক্তি বিনাশে আতসবাজি পোড়ানোর উৎসবে। শুরুটা হয়েছিল চিনদেশে, শব্দবাজির এই রমরমা তাই আজও আমরা দেখি সবচেয়ে বেশি চিনদেশের বর্ষবরণ উৎসবে। সশব্দে বাজি পুড়িয়ে অশুভ শক্তি বিনাশ বা বিতাড়নের রীতি নানা ফাঁকফোকর দিয়ে এর পর জায়গা করে নিয়েছে
এ দেশের নানা পৌরাণিক ‘কথা আর কাহানি’তে।
সেই বাঁশের গাঁটে জমে থাকা হাওয়ার সম্প্রসারণ প্রযুক্তি পেরিয়ে রসায়ন বিজ্ঞানের ভাণ্ডার বেড়ে চলেছে। রাসায়নিক কায়দাকানুনে বিবর্তন ঘটেছে দেশীয় নানা শব্দবাজিতে। শব্দবাজির দাপাদাপি আর শ্বাসরোধকারী সালফারের ধোঁয়ায় মানুষ ভয় পেয়েছে, আবার। ভয় পেয়েই দেশের উচ্চতম আদালতে পিটিশন জমা দিয়েছে। জমা পড়েছে স্বাস্থ্য আর মানবিকতার খাতিরে ছয় থেকে চোদ্দো বছর বয়সি তিন কিশোর-কিশোরীর তরফে। কালবিলম্ব না করে আদালত রায় দিয়েছে, এ বছরের দীপাবলিতে ‘ন্যাশনাল ক্যাপিটাল রিজিয়ন’-এ শব্দবাজি বিক্রি করা চলবে না। আগামী ১ নভেম্বর অবধি সমস্ত রকম শব্দবাজি বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা জারি হল উচ্চতম আদালতের সক্রিয়তার ফলে।
এতেই যেন ভাবাবেগে আঘাত লাগল। রে রে করে ঐতিহ্যরক্ষাকারীরা রাস্তায় নেমে পড়েছেন। রাস্তা মানে মূলত নানা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম। দীপাবলি নিয়ে হিন্দুশাস্ত্রে নানা মত, দিক, ব্যাখ্যা থাকলেও, গরিষ্ঠ সংখ্যার ভাবাবেগ জড়িয়ে আছে শ্রীরামচন্দ্রের চোদ্দো বছরের বনবাস শেষে লক্ষ্মণ ও সীতাকে নিয়ে অযোধ্যার ‘রিটার্ন জার্নি’র সঙ্গেই। অযোধ্যাবাসীর এই ফিরে পাওয়ার উৎসবই দীপাবলি। ফিরে আসার পথ জুড়ে আলোর রোশনাই আর পটকার উৎসব। এ সবই ভেবে নেওয়া কাল্পনিক ইতিহাস। দসেরার রাতে রাবণ বধের উল্লাসেই ক্ষান্ত নয় হিন্দু ভারত। রাবণ-বধ শেষে বিজয়ী রামচন্দ্রের ফিরে আসার সশব্দ উল্লাস; দীপাবলির রাতে তার পূর্ণ প্রকাশ। সময়ক্রমের ইতিহাসে বিজয়োল্লাস আর শব্দবাজির আবিষ্কারের হিসেবটা না মিললেও, এটাই ভাবাবেগ।
হিন্দুধর্মের ঐতিহ্যে আর রেওয়াজমাফিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে, এই সুর তুলে ইতিমধ্যে বেশ কিছু ভক্তজনেরা বায়ুদূষণের সঙ্গে সঙ্গে আরও ভয়ংকর সামাজিক দূষণ ছড়িয়ে দিতে চাইছেন। শব্দবাজির যুক্তি হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে ‘অপর’ ধর্মের আচার, রীতিনীতির নানা অনুষঙ্গ। এ ছাড়াও যুক্তি আছে। যেমন, রাজধানী অঞ্চলের চার পাশ থেকে, বিশেষত পঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে চাষবাসের পর জমির যে পড়ে থাকা নাড়া পোড়ানো হয়, আসলে তো সেই ধোঁয়াই জমে বসছে রাজধানীর আকাশে। তার সঙ্গে রয়েছে রাজধানী, নয়ডা, গুরুগ্রামের ক্রমবর্ধমান গাড়ির সংখ্যা। বাজি তা হলে কী দোষ করল! স্বীকার না করে উপায় নেই, বিকাশ যে পথে এগিয়েছে— এই সব কিছুর যোগফল আমাদের বিভিন্ন শহরের নিম্নমানের আকাশ-বাতাস।
তবে ইতিমধ্যেই পরিবেশ দূষিত বলে পরিবেশ দূষণ আরও বাড়িয়ে যাওয়াই যায়, এই যুক্তিও চলতে দেওয়া যায় না। ঘটনা তো এটাই যে, বছরের এই সময়টা যেন আতঙ্কের হয়ে ওঠে গোটা জীবজগতের কাছে। শুধুমাত্র বায়ুদূষণ তো নয়, শব্দদূষণের প্রকোপে রীতিমত ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের শহর বা শহরতলির আশ্রয়ে থাকা পশুপাখির জগৎ। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের আবেদনে সাড়া দিয়ে উচ্চতম আদালত এ বার এই অসহায়তা থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে চাইছে। দূষণ থেকে পরিত্রাণের উপায় কিছুটা হলেও বাতলে দিতে চাইছে। আমরা যেন ভুলে না যাই, গত বছর রাজধানী শহরের সমস্ত স্কুল দীপাবলির পর টানা কয়েক দিন ছুটি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিল ছেলেমেয়েদের এই বিষাক্ত বাতাস থেকে আড়াল করতে। ঠিক এক বছর পরের এই পদক্ষেপটি তাই অত্যন্ত গুরুতর, দায়িত্বশীল। আদালত পরীক্ষা করে দেখতে চায় এই নির্দিষ্ট সময়ে এই পদক্ষেপ করলে বাতাসের মানের ঠিক কতটা সুরাহা হতে পারে।
যে কোনও যুক্তিবাদী পদক্ষেপ বা আধুনিকমনস্কতার প্রথম বাধাটা আসে রক্ষণশীল গোষ্ঠীর কাছ থেকেই। সেই একই সূত্রে, যাঁরা সরাসরি আর স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এই রায়ের বিরোধিতায় নেমে পড়েছেন, তাঁরা যে শুধু রক্ষণশীলতার পরিচয় দিচ্ছেন, তা নয়। এর পাশাপাশি ধর্মীয় আচার, রীতিনীতি আরোপের মাধ্যমে তৈরি করতে চাইছেন গোষ্ঠী-পরিচয়ের বেড়াজাল। এঁরা ঐতিহ্যকে এক রক্ষণশীল মোড়কে মুড়ে ফেলতে চাইছেন। অর্থাৎ, নতুন আলোকে কোনও গতিময় ঐতিহ্য এঁরা সামনে আনতে নারাজ।
দীপাবলি নামান্তরে দিওয়ালি। নয়নাভিরাম আলোকসজ্জার উৎসব দীপাবলি। দিয়া অর্থাৎ দীপের মালা দিয়ে উৎসব যে অনেক মনোগ্রাহী হতে পারে, এমনটা ভাবলে কি ধর্মসত্তা বা ধর্ম-অধিকার খর্ব হয়? আসলে আমরা এখন এমন এক ভারতবর্ষের মুখোমুখি, যেখানে নাগরিক বিষয় বলে কিছু থাকবে না। ধর্মীয় গোষ্ঠীপরিচয়ের মধ্যেই কাটাছেঁড়া হবে সর্বজনীন নাগরিক বিষয়গুলি।
বায়ুদূষণ বা শব্দদূষণ বিরোধী পদক্ষেপের সমালোচনা করে যাঁরা হুংকার দিচ্ছেন, একটু খেয়াল করলেই দেখব, এঁরাই কিন্তু গত দু’বছর যাবৎ স্বচ্ছ ভারত প্রকল্পের ধ্বজাধারী। ভাবটা যেন, স্বচ্ছতার আদি ও শেষ মাপকাঠি ঝাড়ু হাতে সড়ক সাফাই। রাস্তার ওপরের আকাশটা যেন তাঁদের মাথার ওপরেই নেই। অর্থাৎ, স্বচ্ছ ভারতের সরকারি অনুপ্রেরণার বেশির ভাগটাই ঘুরপাক খাচ্ছে এক প্রতীকী সাংস্কৃতিক বিশ্ব পরিবেশনায়। যুক্তিগ্রাহ্য বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির থেকে প্রদর্শনীমূলক স্বচ্ছ অভিযানে আটকে যাচ্ছে আমাদের চোখ।
আইন ভাঙার ফাঁকফোকর খুঁজে ইতিমধ্যেই দিল্লির বিজেপি মুখপাত্র তাজিন্দর সিংহ বাগ্গা আগ বাড়িয়ে ঘোষণা করে দিয়েছেন যে, বস্তিতে, ঝুগ্গি-ঝোপড়িতে উনি শব্দবাজি বিলি করবেন, যাতে ছোট ছোট বাচ্চারা দিওয়ালি শব্দময় করে তুলতে পারে। আদালত বিক্রি বন্ধ করলে কী হবে, বিনা পয়সায় বিলি-বণ্টনে তো কোনও বাধা নেই। খেয়াল করা দরকার, আদালতের বিধিনিষেধ ভাঙার বা চ্যালেঞ্জ করার ধরনধারণেও কিন্তু শ্রেণি বা গোষ্ঠীচরিত্র আছে। বলা যায় না, নিম্নবর্গের সক্রিয়তা হিসেবেও এই চ্যালেঞ্জকে চালিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
আদালত মূলত আইন আর সমাজের মধ্যে একটা যোগাযোগ মাধ্যম বা সেতুর কাজ করে। বিষাক্ত আকাশ থেকে রেহাই দিতে ছোট্ট এই পদক্ষেপ করতে গিয়ে বিচারক বলেছেন, এমন সিদ্ধান্ত সকলের সুবিধার্থে, সর্বজনপ্রিয় হওয়ারই কথা। নির্দিষ্ট কোনও গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক পরম্পরার বিরোধিতা করা হচ্ছে, এমন ভাবার দরকার নেই।
কিন্তু আমরা যতই সর্বজনীন বা সহমতের কথা বলি না কেন, জনপ্রিয় উৎসব পালনের আদবকায়দা যেমন কখনওই শ্রেণিহীন, গোষ্ঠীমুক্ত নয়, আদালতের রায়-লঙ্ঘনও ঠিক তেমনই গোষ্ঠী পরিচালিত হতে পারে। শব্দবাজি সহকারে দীপাবলি পালনের রেওয়াজের সঙ্গে ধর্মীয় সংস্কৃতি বা অধিকার আরোপ করে সেই গোষ্ঠী-বিভাজনকেই উসকানি দেওয়ার কাজটা করা হচ্ছে। আর, উচ্চমার্গীয় ‘গ্রিন দিওয়ালি’ বা ‘গ্রিন দিল্লি’ স্লোগানের উলটো-পিঠে তৈরি হচ্ছে সেই তথাকথিত ‘অ্যান্টি’ ‘নিম্নবর্গীয়’ গোষ্ঠী। ধর্মীয় অনুভূতির যোগসাজশে এই গোষ্ঠী আরও বেশি বিষিয়ে তুলতে সক্ষম আকাশ-বাতাস।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্বের শিক্ষক