সম্পাদকীয় ১

বেওয়ারিশ

অপমৃত্যুর প্রসঙ্গেই কেবল শ্রমিককল্যাণের বিষয়টি সম্মুখে আসে কেন, সেই প্রশ্নও পীড়াদায়ক। ভারতে শিল্পের সংগঠিত ক্ষেত্রে নিয়োগ কমিতেছে। কৃষিতে জমির মালিকানাও কমিতেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৮ ০০:৪৪
Share:

সম্প্রতি ব্যারাকপুর এলাকার একটি কাগজ কারখানার কুয়ায় নামিয়া বিষাক্ত গ্যাসে ছয় শ্রমিক প্রাণ হারাইলেন। মৃত্যুর সংখ্যাটি অধিক বলিয়াই ঘটনাটি কিছু গুরুত্ব পাইয়াছে। বিষাক্ত গ্যাসে শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা, নির্মীয়মাণ অট্টালিকা হইতে পড়িয়া মৃত্যুর ঘটনা প্রায় নিয়মিত সংবাদ হইয়া থাকে। কিন্তু তাহা অতি দ্রুত সংবাদের মিছিল হইতে হারাইয়াও যায়। শ্রমিকের সুরক্ষার বিধি সরকারি নির্দেশিকার নথিভান্ডারেই চাপা পড়িয়া থাকে। বিশেষত যাঁহারা ঠিকা প্রথায় দিনমজুরি করিয়া থাকেন, তাঁহাদের জীবনমৃত্যুর ঠিকঠিকানা নাই। উচ্চ অট্টালিকায় কর্মনিরত শ্রমিকদের ভরসা কোমরের দ়়ড়ি আর বাঁশের কাঠামো। মাথায় হেলমেট নাই। যাঁহারা আবর্জনা পরিষ্কার করেন, তাঁহাদের জুতা-দস্তানা নাই। যেখানে সহজদাহ্য পদার্থ মজুত রহিয়াছে, সেখানে অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা নাই। অতএব কুয়াতে নামিবার পূর্বে গ্যাস-প্রতিরোধক মুখোশের ব্যবস্থা করিতে হইবে, এমন দাবি বোধ করি অবান্তর। যে-কোনও সুস্থ সভ্য সমাজে যে-রক্ষাকবচগুলি প্রাথমিক বা ন্যূনতম বলিয়া স্বীকৃত ও ব্যবহৃত, এ-দেশে অসংগঠিত ক্ষেত্রে, এমনকী অনেক সময়েই সংগঠিত ক্ষেত্রেও সেগুলি কার্যত কল্পনাবিলাস। কাগজকলের ঘটনাটি একটি দৃষ্টান্তমাত্র। প্রশ্ন সামগ্রিক (অ)ব্যবস্থা সম্পর্কে। কেন বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য নিকাশির পাইপ-সংবলিত কুয়াকে শ্রমিকের পক্ষে ‘বিপজ্জনক’ বলিয়া মনে করা হয় না? কেন আপৎকালীন ব্যবস্থা ছাড়াই পঁচিশ ফুট নীচে শ্রমিকদের নামানো হয়? লক্ষণীয়, এই রাজ্যের বহু ঠিকা শ্রমিক ভিন্ন রাজ্য হইতে আগত। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিকরা অন্যান্য রাজ্যে নিহত বা অপদস্থ হইয়াছেন, সেই সংবাদে এই রাজ্যের শীর্ষ নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করিয়াছেন। পশ্চিমবঙ্গে অন্য রাজ্যের শ্রমিকের অপমৃত্যু ঘটিলে সরকার নীরব থাকে কেন? যাঁহারা উত্তর দাবি করিতে পারেন, তাঁহাদের কি উত্তর দিবার দায় নাই?

Advertisement

অপমৃত্যুর প্রসঙ্গেই কেবল শ্রমিককল্যাণের বিষয়টি সম্মুখে আসে কেন, সেই প্রশ্নও পীড়াদায়ক। ভারতে শিল্পের সংগঠিত ক্ষেত্রে নিয়োগ কমিতেছে। কৃষিতে জমির মালিকানাও কমিতেছে। দিনমজুরি ও খেতমজুরি ক্রমশ অধিকতর লোকের রোজগারের উৎস হইয়া উঠিতেছে। এই বিপুল মানবসম্পদ অর্থনীতির চালিকাশক্তি, অথচ নিত্য অবহেলিত। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের সুরক্ষা, প্রাণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করিবার সরকারি বিধি রহিয়াছে। কিন্তু চতুর ঠিকাদার, ব্যয়কুণ্ঠ নিয়োগকর্তা এবং উদাসীন শ্রমিক সংগঠন ঠিকা শ্রমিকদের প্রাপ্য হইতে বঞ্চিত করিতেছে। তাঁহাদের জীবনের সুরক্ষা নাই, সামাজিক সুরক্ষাও নাই। স্বাস্থ্য বিমা, দুর্ঘটনা বিমা, ভবিষ্যনিধি বা অবসর ভাতার সুবিধা তাঁহাদের কত জনের নিকট পৌঁছাইয়াছে? সরকারি আধিকারিক হইতে শ্রমিক নেতা, কে সেই দায় পূরণ করিতেছেন?

ভারতে নিয়োগ ও শ্রমের বাজারের চিত্র দ্রুত বদলাইতেছে। নিয়মিত বেতনের কাজের সুযোগ ক্রমশই সঙ্কুচিত হইতেছে। দীর্ঘমেয়াদি কর্মসংস্থান কমিতেছে, স্বল্পমেয়াদের কাজের সংখ্যা বাড়িতেছে। বিভিন্ন শিল্পে শ্রমিক নিয়োগ এবং ছাঁটাই উত্তরোত্তর সহজ করিয়াছে কেন্দ্রীয় সরকার। নিয়োগনীতিতে এই নমনীয়তা দেশের শিল্পকে আরও লাভজনক করিবে ও অর্থনৈতিক উৎপাদন বৃদ্ধির সহায়ক হইবে, এমন ধারণার পক্ষে প্রবল যুক্তি আছে। অর্থনীতির যুক্তি। কিন্তু এই অ-নিয়ন্ত্রিত শ্রম-বাজার যাহাতে একটি উন্নত অর্থনীতির ভিত হিসাবে কাজ করিতে পারে, সে-জন্যও ঠিকা শ্রমিকের নিরাপত্তা বিধান অত্যাবশ্যক। শ্রমিকের নিরাপত্তার প্রশ্নটিকে দীর্ঘকাল সমাজতন্ত্রের ভুল চশমা দিয়া দেখা হইয়া আসিয়াছে। আজ সেই চশমা গিয়াছে। সুলক্ষণ। কিন্তু শ্রমিকের নিরাপত্তা জলাঞ্জলি দিবার কোনও যুক্তি থাকিতে পারে না। অবাধ অর্থনীতি আর অর্থনীতির নৈরাজ্য এক নহে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন