‘ভবিষ্যতের ভূত’।
ক্ষমতার সম্মুখে স্বাধীনতা করজোড়ে দাঁড়াইতে পারে না।— বর্তমান ভারতে অগণিত প্রসঙ্গে এই কথাটি স্মরণ করাইয়া দেওয়া যাইত। ‘ভবিষ্যতের ভূত’ নামক ছবিটির মুক্তিসংক্রান্ত জটিলতার প্রেক্ষিতে কথাটি বলিল বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় ও বিচারপতি হেমন্ত গুপ্তের বেঞ্চ। যে জল্পনা হাওয়ায় ভাসিতেছিল, আদালত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তাহাই বলিল: ইহা সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহারের নিদর্শন। রাজ্য পুলিশ তাহার এক্তিয়ারের বাহিরে গিয়া কাজ করিয়াছে। ইহা ছবির প্রযোজক, অভিনেতা ও দর্শকদের সাংবিধানিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করিবার অসাংবিধানিক প্রচেষ্টা। আদালতের এই তিরস্কার অত্যন্ত সময়োপযোগী। সত্যই কি ছবিটির প্রদর্শন বন্ধ করিয়া দেওয়ার কোনও কারণ রাজ্য সরকারের ছিল? দুর্জনে নানা কারণ দর্শাইতেছেন, সে সবে কান না দিয়াও বলা যায়, রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তের পিছনে কোনও একটি প্রতিহিংসাবোধ কাজ করিতেছিল। আদালতের তিরস্কার হইতে তাই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী একটি শিক্ষা লইতে পারেন— ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক প্রতিহিংসাকে প্রশাসনের কাজে প্রতিফলিত হইতে দিতে নাই। বর্তমান ভারতে কথাটি অলীক ঠেকিতে পারে। কেন্দ্রীয় সরকার যে ভঙ্গিতে সিবিআই-সহ হরেক প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করিয়া চলিতেছে, তাহাতে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ব্যতীত অন্য কোনও উপাদানের সন্ধান পাওয়া দুষ্কর। রাজনীতির স্বার্থে যে ভাবে ‘পদ্মাবত’-এর ন্যায় ছবির পথে বাধার সৃষ্টি করা হইয়াছে, আদালতের রায়ে সেই প্রসঙ্গও আসিয়াছে। এই ভারতে দাঁড়াইয়া আদালতের বক্তব্য হইতে শিক্ষাগ্রহণ করিবার কাজটি কঠিন, সন্দেহ নাই। কিন্তু কঠিন হইলেও কাজটি অবশ্যকর্তব্য।
আদালতের পর্যবেক্ষণ, ‘ভবিষ্যতের ভূত’ ছবিটির ক্ষেত্রে পুলিশ মুখ বন্ধ করাইবার, চালু সংস্কৃতির সমালোচনা বন্ধ করাইবার এবং নাগরিকদের মাথা নুয়াইয়া ফেলিতে হুঁশিয়ারি দেওয়ার হাতিয়ার হইয়া গিয়াছে। এক্ষণে, হাতিয়ার কথাটি তাৎপর্যপূর্ণ। হাতিয়ার স্বেচ্ছায় চলে না, রামপ্রসাদ সেনের ভাষা ধার করিলে বলিতে হয়, ‘যেমন চালাও, তেমনই চলি’। হাতিয়ারটি এমন ভাবে চলিল কেন, তাহার উত্তরও আদালতের রায়েই আছে— উদ্দেশ্য হইল, একটি নজির তৈরি করিয়া দেওয়া, আতঙ্ক তৈরি করা যে অন্য কেহ এই পথে হাঁটিয়া সমালোচনা করিবার চেষ্টা করিলে তাঁহারও একই পরিণতি হইবে। অর্থাৎ, আদালতও মনে করিয়াছে, ইহা শুধু একটি নির্দিষ্ট ছবিকে আটকাইবার আয়োজন নহে, এক জন নির্দিষ্ট পরিচালককে হয়রান করিবার প্রচেষ্টা নহে, এই আচরণের গূঢ়তর উদ্দেশ্য আছে। আশা করা চলে, রাজ্য সরকার এই সুকঠিন তিরস্কারের মর্ম অনুধাবন করিতে পারিবে। কোনও গণতান্ত্রিক সরকারের নিকট এই তিরস্কার কতখানি লজ্জার, তাহা বুঝিবে। এবং, একই সঙ্গে বুঝিবে, গণতন্ত্রকে মবোক্রেসি বা জনতাতন্ত্রের সঙ্গে গুলাইয়া ফেলা যায় না। আদালত বলিয়াছে, শিল্পী কী ভাবে নিজেকে প্রকাশ করিবেন, কী ভাবে করিবেন না, জনমতও তাহা স্থির করিয়া দিতে পারে না। শিল্পীর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করিতে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা সরকারের কর্তব্য। আদালতের এই রায়কে সরকার নিছক বিরুদ্ধতা হিসাবে দেখিতে পারে, এবং ছিদ্র সন্ধান করিতে পারে। অথবা, গণতান্ত্রিকতায় ফিরিবার পথনির্দেশও ভাবিতে পারে। কোনটি ভাবিবে, তাহা পরিণতমনস্কতার প্রশ্ন।