Newsletter

হিসেবটা কিন্তু স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার জনগণকে

কেন্দ্রীয় সরকারই বা আংশিক কর প্রত্যাহার করতে পারবে না কেন? কর কমালে কেন্দ্রের কত ক্ষতি? রাজ্য সরকারগুলির কোষগারই বা কতটা ফাঁকা হবে পেট্রোপণ্যের উপরে কর ছাড় দিলে? এই রকম একগুচ্ছ প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে।

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:৪২
Share:

বিহার, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত, পঞ্জাব, ওড়িশা, তেলঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও কর্নাটকের মতো রাজ্যগুলিতে ভাল ছাপ পড়েছে হরতালের। স্বাভাবিক জনজীবন বিপর্যস্ত হয়েছে। নিজস্ব চিত্র।

অসন্তোষের আঁচটা বোধহয় খানিকটা টের পেল সরকার। ৩১টি মুখ্যমন্ত্রী পদ রয়েছে। তার মধ্যে ১৯টিই বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ-র হাতে। দেশের সংসদেও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিজেপির। স্বাভাবিক ভাবেই হীনবল বিরোধী শিবির। কিন্তু সেই হীনবল বিরোধীদের ডাকা বন্‌ধেই থমকে গেল প্রায় গোটা দেশ। বাংলার শাসকদল নীতিগত বাধ্যবাধকতার কথা বলে বন্‌ধ ব্যর্থ করার ডাক দিয়েছিল। ফলে বাংলায় বন্‌ধ সর্বাত্মক চেহারা নেয়নি। কিন্তু বিহার, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত, পঞ্জাব, ওড়িশা, তেলঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও কর্নাটকের মতো রাজ্যগুলিতে ভাল ছাপ পড়েছে হরতালের। স্বাভাবিক জনজীবন বিপর্যস্ত হয়েছে। দিনের শেষে শাসকের আগ্রাসী কণ্ঠস্বর তাই উধাও। আচমকাই যেন রক্ষণাত্মক অবস্থানে বিজেপি।

Advertisement

গত চার বছরে যে কোনও পরিস্থিতিতেই আত্মবিশ্বাস দেখিয়ে এসেছে বিজেপি। বিরোধীদের যে কোনও সম্মিলিত আক্রমণকেও ফুত্কারে নস্যাত্ করার ভঙ্গি করেছে বার বার। গত চার বছরে মোদী সরকারের যাবতীয় পদক্ষেপ প্রশংসিত হয়েছে, এমন মোটেই নয়। কিন্তু বিজেপি তথা কেন্দ্রীয় সরকার এমন ভঙ্গি বার বার করেছে, যাতে মনে হয়েছে, কারও প্রশংসা বা শংসপত্রের পরোয়াই করেন না নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহরা। রান্নার গ্যাস, পেট্রল, ডিজেল, কেরোসিনের দামে আগুন লেগে যাওয়ার প্রেক্ষিতে দেশজোড়া হরতালের যে ডাকটা দেওয়া হয়েছিল বেশ কয়েকটি বিরোধী দলের তরফ থেকে, সেই হরতালের ছবিটা যেন বিজেপির ভরপুর আত্মবিশ্বাসে একটু ধাক্কা দিয়ে দিল। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে সাংবাদিক বৈঠক করলেন যিনি, সেই রবিশঙ্কর প্রসাদের কণ্ঠে যেন চেনা ঝাঁঝ আর নেই।

কী বললেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী? তিনি প্রকারান্তরে স্বীকার করলেন যে, পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সমস্যায় ফেলেছে জনসাধারণকে। তার পরেই যোগ করলেন যে, জনসাধারণ এতে ক্ষুব্ধ নন, কারণ তাঁরা জানেন যে এই সমস্যা স্থায়ী নয়। স্থায়ী হোক বা অস্থায়ী, সমস্যায় যে রয়েছেন দেশবাসী, মোদী ক্যাবিনেটের কোনও সদস্য তা মানছেন, এমন দৃশ্য খুব একটা দেখা যায় না। বুঝতে বাকি থাকে না যে, হরতালের চেহারাটা উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে শাসক শিবিরে।

Advertisement

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

তবে পেট্রোপণ্যের দাম শুধু মোদী জমানায় বেলাগাম হয়ে পড়েছে, এমনটা শাসক মানছেন না। ইউপিএ জমানায় বছরে গড়ে কত টাকা করে বেড়েছিল দাম, আর গত চার বছরের হিসেব অনুযায়ী পেট্রলের বাত্সরিক গড় মূল্যবৃদ্ধি কত— সেই হিসেব তুলে ধরেছে বিজেপি। পেট্রল-ডিজেলের উপর থেকে রাজ্য সরকারগুলি কর কেন প্রত্যাহার করছে না, বিজেপির তরফে সে প্রশ্নও তোলা হয়েছে।

এ কথা ঠিক যে পেট্রোপণ্যের দামের উপরে কেন্দ্র এবং রাজ্য আলাদা আলাদা করে কর নেয়। বিজেপি বিরোধীরা অন্তত ১১টি রাজ্যে ক্ষমতায় রয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে ওই ১১টি রাজ্যের সরকার পদক্ষেপ করছে না কেন? এই প্রশ্ন বিজেপি তুলেছে। ওই ১১টি রাজ্যে কর যদি প্রত্যাহার করে নেয় রাজ্য সরকার, তা হলেই অনেকটা কমতে পারে পেট্রোপণ্যের দাম, বলছে বিজেপি।

আরও পড়ুন: বন্‌ধ না হয় হল, দামের কী হবে

পেট্রোপণ্যের দাম কমানোর একমাত্র ফর্মুলা কি তা হলে এখন এটাই? রাজ্যগুলি কর প্রত্যাহার করলে তবেই কমবে পেট্রোপণ্যের দাম? তাই যদি হয়, তা হলে বিজেপি তথা এনডিএ শাসিত ১৯টি রাজ্যে কর প্রত্যাহার করে পথ দেখানো হচ্ছে না কেন? পেট্রোপণ্যের মূল্যের উপর কেন্দ্রীয় করের পরিমাণটাও তো নেহাত কম নয়। সেটাই বা কমানো হচ্ছে না কেন? পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জেরে আক্রমণের শিকার তো বিজেপিকেই হতে হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে দাম কমানোর কোনও উপায় জানা থাকলে বিজেপি-ই সর্বাগ্রে তা প্রয়োগ করবে, এমনটাই তো প্রত্যাশিত।

আরও পড়ুন: তেল-সমস্যা সমাধানের দায় এড়িয়ে গেল কেন্দ্র

দাম যে কোথাও কমছে না, তাও কিন্তু নয়। কংগ্রেস তথা ইউপিএ শাসিত পঞ্জাব এবং কর্নাটক নিজেদের কর কিছুটা প্রত্যাহার করছে বলে সর্বাগ্রে শোনা গিয়েছে। পরে শোনা গিয়েছে বিজেপি শাসিত রাজস্থান এবং চন্দ্রবাবুর অন্ধ্রপ্রদেশ কর আংশিক প্রত্যাহার করছে। প্রশ্ন হল, এই রাজ্যগুলিতে সম্ভব হলে অন্যগুলিতে নয় কেন? কেন্দ্র বলছে রাজ্য কর কমাক। রাজ্য বলছে কেন্দ্র কর কমাক। কয়েকটি রাজ্য কর কমানোর পথে হাঁটছে। বাকিরা কমাচ্ছে না। অতএব কোথাও পেট্রোপণ্যের দাম কমছে, কোথাও ঊর্ধ্বগতি বহাল থাকছে। এই রকম পরিস্থিতি তৈরি হবে কেন? পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা যায় কি না, তা নিয়ে জনগণকে এই রকম ধোঁয়াশার মধ্যে থাকতে হবে কেন? বিরোধী দলগুলির হাতে থাকা কয়েকটি রাজ্য যখন কর কমাচ্ছে, তখন বাকিরা কমাচ্ছে না কেন? বিজেপি শাসিত একটি রাজ্য যদি কর কমাতে পারে, তা হলে বাকি ১৮টি রাজ্য সে পথে হাঁটবে না কেন? কেন্দ্রীয় সরকারই বা আংশিক কর প্রত্যাহার করতে পারবে না কেন? কর কমালে কেন্দ্রের কত ক্ষতি? রাজ্য সরকারগুলির কোষগারই বা কতটা ফাঁকা হবে পেট্রোপণ্যের উপরে কর ছাড় দিলে? এই রকম একগুচ্ছ প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই প্রশ্নগুলোর স্পষ্ট জবাব জরুরি। রাজ্যের আয়ের সুযোগ কম, তাই রাজ্য পেট্রোপণ্যের উপর থেকে কর প্রত্যাহার করতে পারবে না, কেন্দ্র বরং কিছুটা ত্যাগ স্বীকার করুক— পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি যখনই হয়, তখনই এই প্রস্তাবনা উঠে আসে। কিন্তু কর কমালে কার কতটা ক্ষতি, কোন রাজ্যের কোষাগারে কতটা চাপ পড়বে, তাতে উন্নয়ন কতখানি আটকাতে পারে, এ সবের স্পষ্ট হিসেব প্রায় কেউই দিতে চান না। এই ধোঁয়াশাও কিন্তু খুব আপত্তিকর। জনগণের কাছ থেকে কর আদায় করা হচ্ছে। সেই কর সাময়িক ভাবে প্রত্যাহার করলে জনগণের সুরাহা হতে পারে বলে রাজনৈতিক নেতৃত্বই মন্তব্য করছেন। কিন্তু কী সুরাহা, কতটা সুরাহা, তার জন্য অন্য দিকে কতটুকু ত্যাগস্বীকার— সে সব প্রশ্ন নিয়ে ধোঁয়াশা বহাল রাখা হচ্ছে। এই ধোঁয়াশা অত্যন্ত আপত্তিকর। জনগণকেও জানতে দিন, স্পষ্ট ছবিটা ঠিক কী রকম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন