খেপিয়ে তোলা তথ্যের দেশ

এই ধর্ম-পরিচয় আমাদের জন্মসূত্রে প্রাপ্ত, এ বিষয়ে আমাদের বিশেষ কৃতিত্ব নেই। কিছু দিন আগে কৃতিত্ব দাবির চলও ছিল না। দু’পক্ষকে লড়িয়ে দেওয়ার ফলে হিন্দুত্বের বোধ বিশেষ ভাবে জাগ্রত হয়ে উঠেছে।

Advertisement

ঈশা দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০১৯ ০০:০৫
Share:

নির্বাচনের আঁচ কিছুটা কমে এসেছে, কিন্তু সাম্প্রদায়িক অভব্যতার রেখাচিত্র ক্রমশই ঊর্ধ্বগামী। গোরক্ষকদের অত্যাচার, কিছু শব্দবন্ধের অকারণ উচ্চারণের জোরজুলুম। ইদানীং এ ধরনের ঘটনার সংখ্যা এতই বেশি, ক্রমশই গা-সওয়া হয়ে যাচ্ছে আমাদের, গণতন্ত্রের। এই সহ্য করে নেওয়া, মেনে নেওয়া কি আমাদের অন্যান্য অন্যায় গলাধঃকরণের অভ্যাসের মতোই স্বাভাবিক, না কি এই অভ্যবতার অভ্যাসের অন্য কোনও মাত্রা আছে?

Advertisement

হিন্দুধর্মের মধ্যেও উচ্চবর্ণের হিন্দুদের অন্ত্যজ, দলিতদের প্রতি বর্বরতার নিদর্শন কম নেই। তবে সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে হিন্দু আক্রোশ মূলত এক ধর্মের প্রতিই। দেশে মোট সংখ্যালঘুদের ভাগ ২০.২%, যার মধ্যে ১৪.২% ইসলামধর্মী। কিন্তু দীর্ঘ দিনের লালিত রাজনৈতিক অভ্যাসে লড়িয়ে দেওয়া হয়েছে মূলত এই দু’পক্ষকেই, অন্যদের ধর্তব্যে আনা হয়নি। আর এই দুই পক্ষের মধ্যে, এখনও পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে দৃষ্টিকটুতার সামনের সারিতে আমরা, যারা জন্মসূত্রে হিন্দুধর্মালম্বী।

এই ধর্ম-পরিচয় আমাদের জন্মসূত্রে প্রাপ্ত, এ বিষয়ে আমাদের বিশেষ কৃতিত্ব নেই। কিছু দিন আগে কৃতিত্ব দাবির চলও ছিল না। দু’পক্ষকে লড়িয়ে দেওয়ার ফলে হিন্দুত্বের বোধ বিশেষ ভাবে জাগ্রত হয়ে উঠেছে। তাই প্রায়ই চলছে অশ্লীল উচ্চারণ: “যে ভাবে সংখ্যায় বাড়ছে, দেশটা এ বার ওদেরই দেশ হয়ে যাবে।” দেশটা ‘ওদের’ও, বংশানুক্রমে ‘ওরা’ এ দেশে বাস করে। জন্মনিরোধ সম্পর্কে ইসলামের প্রাচীন ধর্ম-নিষেধাজ্ঞার কথা (আর তাই ‘ওদের’ সংখ্যায় বেড়ে ওঠার কথা) বারংবার বলা হয়। একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা ক্যাথলিক ধর্মমতেও উল্লিখিত। জন্মনিয়ন্ত্রণ, গর্ভপাতের অধিকার নিয়ে আয়ারল্যান্ড, পোল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও কত আন্দোলন। তথ্য বিস্ফোরণের যুগে সে সব কথা আমাদের কাছে এসে পৌঁছয় না তা-ও নয়। তবু তাদের কথা বলি না তো আমরা। পৃথিবীর জনসংখ্যা-বিস্ফোরণে তাদেরও দায় থাকতে পারে। ভারতের আজকের জনবিস্ফোরণের দায় আমাদের হিন্দু পূর্বপুরুষদেরও কম নয়। মূল বিষয়টি যে হিন্দু, মুসলিম, ক্যাথলিক নয়— শিক্ষা ও বিজ্ঞানমনস্কতা। তাও আমাদের অজানা নয়। তবু এক বিশেষ ধর্মমতাবলম্বীদের দিকে আঙুল তোলা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছাড়া আর কী?

Advertisement

মজার ব্যাপার হল, নিজেদের এই একপেশে, অযৌক্তিক ব্যবহার নিয়ে আমাদের কোনও লজ্জা নেই। হয়তো কোনও দিনই ছিল না। এখন রাষ্ট্রের অনুমতি আছে, তাই নির্লজ্জ উচ্চারণে আর অসুবিধে নেই। ‘ওদের’ দেশ থেকে তাড়িয়ে পাশের দেশে পাঠানো কেন প্রত্যেক হিন্দুর অবশ্যকর্তব্য, সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত অঞ্চলে ক্রিকেট ম্যাচে প্রতিবেশী দেশের ফ্ল্যাগ ওড়ে কী প্রতাপে, রাজনৈতিক নেতানেত্রী কী ভাবে ‘ওদের’ তোষণ করছেন— তা নিয়ে মর্নিং ওয়াক থেকে সান্ধ্য আলোচনা সরগরম। ‘ওরা’ কেন হজযাত্রায় ভাতা পাবে? ইমাম ভাতা পাবে? কিন্তু ঠিক তথ্য হল, ভারতে অসংখ্য তীর্থযাত্রার জন্য ভাতার ব্যবস্থা আছে, যার মধ্যে অধিকাংশই হিন্দু। এর মধ্যে বৃহত্তম হল কুম্ভমেলা। ২০১৪ সালের কুম্ভমেলায় কেন্দ্রীয় সরকার খরচ করে ১১৫০ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে, কেন্দ্রীয় সরকার মধ্যপ্রদেশের মহাকুম্ভের জন্য খরচ করে ১০০ কোটি টাকা, আর মধ্যপ্রদেশ সরকার খরচ করে ৩৪০০ কোটি টাকা। মানসরোবর যাত্রার ভাতার ব্যবস্থা আছে ছত্তীসগঢ়, দিল্লি, গুজরাত, কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডের মতো রাজ্যে— রাজ্য পিছু খরচ যেখানে ১.৫ লক্ষ টাকা প্রত্যেক বছরে। কিন্তু এই তথ্য হোয়াটসঅ্যাপে ‘মুচমুচে’ হয়ে ছড়ায় না।

এ দেশের ইতিহাসে ‘ওদের’কে ‘ওদের’ দেশে পাঠাবার এক ভয়ঙ্কর প্রচেষ্টা হয়েছিল এক বার। সে প্রজন্মের কেউ আর বেঁচে নেই, তবু তাঁদের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা আমরা সবাই শুনেছি, পড়েছি, পর্দায় দেখেছি। কিন্তু সে সব মনে নেই আমাদের। মনে রাখতে দিচ্ছে না এ রকম অনেক ‘বাছাই’ তথ্যের ধাক্কা। দেশের নামকরা প্রযুক্তি-স্কুল থেকে পাশ-করা ছাত্রেরা এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। ‘খেপিয়ে দেওয়া তথ্য’ কী ভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তা তাঁরা নির্ভুল জানেন। তাঁরা ১৯৯১, ২০০২ সালের দাঙ্গার কথা ভুলিয়ে দিতে পেরেছেন নিপুণ ভাবে। গোধরা কাণ্ডের রায়ের কথা, রামমন্দির নির্মাণের রায়ের কথা কাগজের পাতায় আসে, হোয়াটসঅ্যাপে নয়। সেখানে শুধু উরি, পুলওয়ামা, বালাকোট। বিবিসি বলেছে, বালাকোটে কোনও হামলার চিহ্ন পাওয়া যায়নি, একটি গরু এবং এক জন মেষপালক ছাড়া কারও আহত হওয়ার খবর জানা যায় না— সে কথাটা হোয়াটসঅ্যাপের লোকেরা শুনতে চায় না।

মানুষ যখন মারে, তখন মানুষ মরে। হিন্দু না, মুসলমানও না। এ কথা আমরা আগে জানতাম, এখন আর জানি না। আসানসোলের ঘটনার এক বছর হয়েছে মাত্র। নিজের ছেলের মৃতদেহের সামনে স্থির থেকেছিলেন ইমাম মৌলানা ইমাদাদুল্লাহ রশিদি। তাই, আমরা আজও সুরক্ষিত।

কিন্তু কত দিন?

ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন