হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলে একটা ক্লাসে জয়া মুখোপাধ্যায় পড়ানো শুরু করলেন একটা প্রশ্ন দিয়ে: স্বাস্থ্য বিষয়ে সর্বাধিক প্রচলিত উপদেশটা কী? প্রায় সব ক’টা হাত উঠে গেল— উত্তরটা তো জানা, প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিয়োর। রোগ নিরাময়ের চেয়ে রোগ প্রতিরোধ উত্তমতর। পিতৃসূত্রে বাঙালি নাম পাওয়া জয়া জন্মজাত আমেরিকান, বাংলা ভাষা বা কৃষ্টির সঙ্গে কোনও যোগ নেই। তবু তাঁর প্রতিক্রিয়াটা ছিল দীর্ঘ একটা ‘নো’, ঠিক বাঙালিদের মতোই। “হ্যাঁ, ঠিকই বলছ, কিন্তু সেই সঙ্গে আর একটা ব্যাপারও ভেবে দেখার থাকতে পারে…”, গোছের পশ্চিমি বিদ্যাচর্চার প্রচলিত ভঙ্গিতে তিনি কেন যাননি, তার উত্তরটা পাওয়া গিয়েছিল পরে। “কিছু ব্যাপার আছে যেখানে ‘না’ কথাটার উচ্চারণও হতে হয় ‘না’-ই।’’ হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের পল ফার্মার-এর নেতৃত্বে জয়া এবং আরও অনেকে রীতিমত একটা যুদ্ধ চালাচ্ছেন আফ্রিকা-ক্যারিবিয়ান-ল্যাটিন আমেরিকা-রাশিয়ার কোটি কোটি পীড়িত মানুষকে এইচআইভি এডস, যক্ষ্মা, ইবোলা-র মতো প্রাণঘাতী মহাশত্রুর হাত থেকে মুক্তি দিতে। অন্য দিকে জনস্বাস্থ্যের প্রবক্তারা প্রতিরোধের বাণী বিতরণ করে যাচ্ছেন। এইচআইভি এডস প্রসঙ্গে বিশ্বের ক্ষমতাবানদের বক্তব্য ছিল— যৌন নৈতিকতার উপর ভর করে রোগ-প্রতিরোধ।
জয়া সেই ক্লাসে টেনে এনেছিলেন এডস রোগীদের রাজনৈতিক-সামাজিক অ-স্বাধীনতার কথা। জর্জ বার্নার্ড শ’র পিগমেলিয়ন নাটক থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন: “তোমার কি নৈতিকতা বলে কিছু নেই?”— “না, হুজুর, ওই বিলাসিতাটা আমরা করতে পারি না; আপনিও পারতেন না, যদি আমাদের মতো গরিব হতেন।”
রোগ প্রতিরোধ নিশ্চয় দরকারি। প্রতিষেধক স্বাস্থ্যসুরক্ষা এ-বিশ্বে বহু অকালমৃত্যু আটকেছে। যদি পৃথিবীর জনসমুদয়গুলোর মধ্যে সুযোগসাম্য থাকত তা হলে আফ্রিকাসহ শাসিত বিশ্বের নানা প্রান্তের ব্যাপক মানুষ প্রতিরোধের সুফল থেকে বঞ্চিত হতেন না। কিন্তু সমস্যা হল, যে জনসমুদয়ের জন্য প্রতিরোধের নিদান দেওয়া হয়, তাঁদের পুষ্টির জন্য, শিক্ষার জন্য, প্রাথমিক চিকিৎসা পরিষেবার জন্য কোনও ব্যবস্থা তো নেওয়া হয়ই না, উলটে সেই তাঁদেরই প্রাকৃতিক ও মানব সম্পদ লুট করে তথাকথিত উন্নত বিশ্ব সম্পদের পাহাড় গড়ে।
প্রতিরোধের উপর প্রাধান্য দেওয়ার দ্বিতীয় এবং আরও মারাত্মক ফল হল, কার্যত এটাকেই সুস্বাস্থ্যের একমাত্র উপায় বলে কৌশলী প্রচার চালিয়ে যাওয়া। এতে এক দিকে যেমন যারা কিনতে পারে না এবং সেই না-পারা নিয়ে অসন্তোষটুকুও ব্যক্ত করতে পারে না, তাদের জন্য স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করার দায় ঝেড়ে ফেলা হয়, অন্য দিকে তেমনই অস্বীকার করা হয় বিজ্ঞানকে। বিশ্ব-স্বাস্থ্যের লক্ষ্যে, পল ফার্মার-এর প্রায়শ ব্যবহৃত দুটো জরুরি ধারণা হল: কার্যকারণ বিষয়ে অ-নম্র দাবির (ইমডেস্ট ক্লেম অব কজালিটি)-র বিরোধিতা, এবং স্বাস্থ্যকে শুধু জীববিজ্ঞানের দিক থেকে না দেখে এ-বিষয়ে একটা জৈব-সামাজিক (বায়ো-সোশ্যাল) দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা। বিজ্ঞানে স্থিত মন ভূগোল মানে না।
সেটাই যেন পুনঃপ্রমাণ করতে কলকাতার মতো এক গ্রাম-নগরে বসে বাংলার ক্ষীণ হতে থাকা বিদ্যাচর্চায় বিবিধতার সংস্কৃতি ধরে রাখায় ব্রতী, স্থবির দাশগুপ্ত বাংলা ভাষার পাঠকদেরও একই কথা বলে যাচ্ছেন। জীবন যাপন ও ক্যানসার (ধানসিড়ি, কলকাতা) বইতে দার্শনিক লিউয়িস টমাসকে উদ্ধৃত করে স্থবির জানাচ্ছেন, “জীববিজ্ঞানের জাহাজটা এই সবেমাত্র চলতে শুরু করেছে; তাই উচ্ছলতার চেয়ে সতর্কতা আরও বেশি জরুরি।” মানবদেহের গতিপ্রকৃতি জটিল; এটা করলে ওটা হয় বা হয় না, নিশ্চিত ভাবে এমন কথা বলার মধ্যে, “ভাবাবেগ যত আছে, যুক্তি ততটা নেই।” কার্যকারণ বিষয়ে এই অ-নম্র দাবিটাই অবিজ্ঞান। আমাদের নম্রতার সঙ্গে জানতে হবে। পাশাপাশি, তিনি প্রশ্ন তুলছেন, প্রতিষেধক স্বাস্থ্যের উপর জোর দিতে গিয়ে যে রাশি-রাশি রাশিগাণিতিক তথ্য সাজিয়ে দেওয়াকে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান বলে চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তা নিয়ে। ‘লাইফ স্টাইলের তদন্তে শার্লক হোমস ও ওয়াটসন’ নামক হালকা চালে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা লেখা প্রবন্ধে তিনি শার্লককে দিয়ে বলাচ্ছেন, “বিজ্ঞান আমার কাছে একটা জিজ্ঞাসা… পাখি উড়তে উড়তে এও জানে সে কোনওদিনই দিগন্ত পেরোতে পারবে না। তবু সে ওড়ে; কারণ ডানা দুটো তার অহংকার… বিজ্ঞান আমার কাছে ঠিক তাই… অথচ কেউ কেউ ভাবেন বিজ্ঞান যেন একটা যাদুকাঠি; সেটা ছুঁইয়ে বিজ্ঞানীরা প্রকৃতির অমৃতভান্ডার থেকে যখন দরকার তখনই একটু একটু করে অমৃত আমাদের হাতে ঢেলে দেবেন।”
জিজ্ঞাসার বদলে জাদুকাঠি করে তোলার প্রক্রিয়ায় এক দিকে যখন যক্ষ্মা রোগী ওষুধ পায় না, তখন অন্য দিকে গড়ে ওঠে ক্যানসার নিয়ে কার্যকারণ তত্ত্বের বিপুল শিল্প-কারখানা, ‘ব্যবসার আয়তনে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম’। অথচ দরকার, মৌলিক গবেষণা— যেমন প্রতিরোধের পথ খোঁজা, তেমনই সামাজিক বিবিধতাগুলোকে মাথায় রেখে, জৈব-সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে রোগের কারণ ও তার প্রতিকারের ব্যাপারে অগ্রসর হওয়া।
কিন্তু তাতে কর্পোরেট মালিকদের আগ্রহ নেই, তারা চায় মুনাফা। অতএব গবেষণার অভিমুখও হয় সেই দিকে, কারণ রাষ্ট্রের উপরও তাদেরই নিয়ন্ত্রণ, এবং ফল হিসাবে মৌলিক গবেষণার জন্য রসদ জোটে না, জোটে নিত্যনতুন ওষুধ আবিষ্কারে, যে-ওষুধের দাম সাধারণের নাগালের বাইরে। সেই সঙ্গে চলে সাবধানতার নামে ভয়ের উৎপাদন, এবং চলতে থাকে কল্পিত ভয়কে প্রতিরোধের নিদান-প্রদান। তার হাত ধরে আসে স্বাস্থ্যবিমা নামক ঘোর অবৈজ্ঞানিক এক ব্যবসা— কার কখন কী রোগ হবে, তার নিরাময়ে কত খরচ হবে, সে অনুমানের ক্ষমতা বিজ্ঞান আজও আয়ত্ত করতে পারেনি, অথচ উদ্ধত কর্পোরেট বিজ্ঞানের নাম করে প্রকৃতির সঙ্গে এক বিষম অনৈতিক যুদ্ধে নামে। এই সূত্র ধরে ডাক্তারি ও এমন বলীয়ান হয়ে ওঠে যে, “সে এখন নির্ব্যাধির মধ্যে ও ব্যাধি খুঁজে বার করতে পারে, তার চিকিৎসাও করতে পারে।’’
আর, মানুষকে তার দেহ নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত করে গড়ে ওঠে বিপুল স্বাস্থ্য-বাণিজ্য— পরীক্ষানিরীক্ষা, ওষুধ, আইসিসিইউ, ভেন্টিলেশন। যার উৎসও আসলে রোগ-প্রতিরোধের অহর্নিশ ভাবনা। স্থবির প্রশ্ন তোলেন, এই ভাবনায় বিজ্ঞানের সঙ্গে দর্শনের বিয়োগ, বিজ্ঞানের মালাচন্দন পরানো কর্পোরেট ব্যবসাবুদ্ধির চাষবাসকে নিষ্প্রশ্ন মেনে নিয়ে মানব সমাজ কোন উত্তরণের স্বপ্ন দেখতে পারে? আমাদের শিক্ষায় “ব্যাধি-নির্ব্যাধির রহস্যময়তা ডাক্তারির নবীন ছাত্রকে বিচলিত করতে পারে না।’’ এর পর যোগ করছেন এক চিরকালীন দার্শনিক উপলব্ধি: “যে বিচলিত হয়না সে তো অন্ধই থাকে।’’
অন্ধত্বও একটা অসুখ। সেই অন্ধত্বে আমরা ধূম্রপান থেকে ক্যানসারের উৎপত্তির সরল গল্পটা সহজে মেনে নিই, কিন্তু ডিজেলের ধোঁয়া নিয়ে নীরবতা আমাদের মনে প্রশ্ন তোলে না। মুনাফাধর্মী ব্যবসায়ীদের লোভের কারণে সিলিকোসিস, যক্ষ্মাসহ নানান সহজেই পরিহার্য রোগে লক্ষ-লক্ষ মানুষের অকালমৃত্যু, তাঁদের পরিবারগুলোর সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া, তার কোনও কিছুই আমরা দেখতে পাই না। কারণ, দেখতে চাই না। প্রতিরোধ যে নিরাময়ের চেয়ে উত্তমতর, সে-কথাটা এখানে খাটাতে গেলে যে কাঠামোগত সংস্কার দরকার, রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠিত সমাজ তা করবে না।
শুধু ডাক্তারদের নির্বিকারকে দোষ দিয়ে লাভ নেই; তাঁরাও এই খণ্ডিতবুদ্ধি সমাজেরই জাতক, যে-সমাজে স্বাস্থ্য মানে সুখ নয়, স্বাস্থ্য এক গভীর অসুখ। এ-অসুখের প্রতিষেধক খোঁজাটা বিপজ্জনক, কেন না সেই প্রতিষেধকের দেখা পেতে আমাদের এমন এক সমাজের দিকে যাত্রা করতে হবে যেখানে পাটোয়ারি বুদ্ধি নয়, মানুষ বিকশিত হবে নৈতিক দর্শনসঞ্জাত বিজ্ঞানের পথ ধরে। স্বাস্থ্য সেখানে প্রতিরোধের বা নিরাময়ের ব্যাপার নয়, সে হবে ‘সকল মানুষের অধিকারের ব্যাপার’।