উচ্চশিক্ষার অর্থ তা হলে প্রতিযোগিতায় বাজিমাত করা?

এই মাপকাঠি কত দূর সঙ্গত

উৎকৃষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসাবে যেগুলি আজকাল সংবাদমাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রে, জাতীয়/আন্তর্জাতিক স্তরে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের নিরিখে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণে উদ্যত, সেগুলি তালিকার ওপর দিকে।

Advertisement

সোমেশ্বর ভৌমিক

শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৮ ০০:৪৬
Share:

দেশের বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূল্যায়ন করে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন-মন্ত্রক গত ৩ এপ্রিল একটি ক্রমতালিকা প্রকাশ করেছে। এই নিয়ে পর পর তিন বছর এ রকম তালিকা প্রকাশ করা হল মন্ত্রকের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউশনাল ‍র‌্যাঙ্কিং ফ্রেমওয়ার্ক (এনআইআরএফ) কার্যক্রমের আওতায়। উচ্চশিক্ষায় উৎকর্ষ বাড়ানোর লক্ষ্যে একটি ‘প্রতিযোগিতা’র আবহাওয়া তৈরি করতে এই সরকারি উদ্যোগটি শুরু হয়েছিল ২০১৫ সালে। নির্দিষ্ট কয়েকটি পরিসংখ্যান সূচকের সাহায্যে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের মূল্যায়ন করা হয়। এগুলি হল— শিক্ষার পরিবেশ ও সম্পদের ব্যবহার, গবেষণা ও পেশাদারি কাজকর্ম, স্নাতকদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা, প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সামাজিক বর্গের উপস্থিতি, আর প্রতিষ্ঠান বিষয়ে ধারণা। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানগুলির দেওয়া তথ্যকেই অঙ্কের হিসাবে রূপান্তরিত করে তালিকা তৈরি হয়েছে।

Advertisement

উৎকৃষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসাবে যেগুলি আজকাল সংবাদমাধ্যমে আলোচনার কেন্দ্রে, জাতীয়/আন্তর্জাতিক স্তরে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের নিরিখে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণে উদ্যত, সেগুলি তালিকার ওপর দিকে। তাদের সামনে বিপুল অনুদানের হাতছানি। স্বশাসন-সহ একগুচ্ছ বাড়তি সুবিধার কথা বলেছেন শিক্ষামন্ত্রী। অবশ্য এমন কিছু প্রতিষ্ঠানও ভাল ফল করেছে, যাদের সরকার সন্দেহের চোখে দেখে। বলা হয়, তারা গোলমালের আখড়া, দেশদ্রোহীদের স্বর্গভূমি। তাদের জন্যে কী ব্যবস্থা করা হয়, দেখার আগ্রহ রইল।

অবশ্য, এরই মধ্যে মূল্যায়ন-পদ্ধতির বেশ কিছু দুর্বলতা প্রকট হয়ে উঠেছে। সরকার নিজেই জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠানগুলির দাখিল করা তথ্য যাচাইয়ের কোনও ব্যবস্থা করা হয়নি। অর্থাৎ, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির কর্ণধারদের ওপর সরকারের অগাধ আস্থা। কিন্তু গত তিন বছর ধরেই নানা মহল থেকে সরকারকে যে এ বিষয়ে সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে, তার নিশ্চয়ই কিছু ভিত্তি আছে। বিশেষ করে আজকাল নিছক ব্যবসায়িক উদ্যোগ হিসাবে যে সব প্রতিষ্ঠান তৈরি হচ্ছে, এ ব্যাপারে তাদের নিয়ে ভাবনাচিন্তার অবকাশ আছে বইকি। এই সমস্যা কাটানোর জন্যে পরামর্শ, এমনকী সাহায্যও পাওয়া যাবে, এমন প্রতিষ্ঠান এ দেশেই আছে। যেমন, জাতীয় পরিসংখ্যান কার্যালয় (এনএসও), অথবা ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট (আইএসআই)। পরিসংখ্যান সংগ্রহ আর বিশ্লেষণ করার কাজে এদের দক্ষতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। এমনকী এদের পরামর্শে মূল্যায়নের নীতি বা পদ্ধতিগত ত্রুটিরও সংশোধন হতে পারে। বিস্তারিত বলার সুযোগ এখানে নেই। একটিমাত্র গুরুতর ত্রুটির কথাই তুলব।

Advertisement

‘টিচিং লার্নিং অ্যান্ড রিসোর্সেজ’ নামে একটি মূল্যায়ন-সূচকগুচ্ছ তালিকার শুরুতেই আছে। এই গুচ্ছের শেষ অংশটি হল, প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সম্পদ এবং তার ব্যবহার। এতে প্রথমে দেখা হয়, গত তিন বছরে ছাত্র-পিছু খরচের বার্ষিক গড়। তার পর, শিক্ষামূলক কাজকর্মের নিরিখে তিন বছরে ছাত্র-পিছু মূলধনী খরচের বার্ষিক গড়। শেষে, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের বেতন আর প্রতিষ্ঠানের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে তিন বছরে ছাত্র-পিছু চলতি খরচের বার্ষিক গড়। খরচের এই পরিসংখ্যানকে ব্যবহার করা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা এবং উৎকর্ষ মাপার কাজে। অথচ কোথাও প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সম্পদের সূত্র নিয়ে তথ্য চাওয়া হচ্ছে না।

দেশের উচ্চশিক্ষার অবস্থাটা জানলে বোঝা যায়, গত কয়েক বছরে আর্থিক সম্পদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে দুর্বলতার জন্যেই বহু প্রতিষ্ঠানের উৎকর্ষহানি হয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির বয়স কম, কিন্তু তাদের সম্পদ সংগ্রহের পরিকাঠামো, কৌশল ও দক্ষতা উচ্চমানের। অন্য দিকে, দীর্ঘ দিন ধরে সরকারি সাহায্য ও অনুদানের ওপর নির্ভর করার ফলে সম্পদ সংগ্রহে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির আগ্রহ কম, পরিকাঠামো দুর্বল, দক্ষতাও সীমিত। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যেও অসাম্য আছে। কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সম্পদ রাজ্য স্তরের প্রতিষ্ঠানের চেয়ে অনেক বেশি। এই মৌলিক বিষয়টিকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনা হয়নি দেখে অবাক হলাম। এতে তো মূল্যায়ন পদ্ধতিটিই যুক্তিগ্রাহ্যতা হারাল!

তা ছাড়া, সরকারি সিলমোহর থাকা সত্ত্বেও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে অধিকাংশই এখনও এনআইআরএফ-এর মূল্যায়নে যোগ দেয়নি। অনুপাতের হিসাবে এ বছরে যোগ নেওয়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১০ শতাংশেরও কম। ফলে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন থাকবে। প্রতিষ্ঠানগুলোর যোগ না দেওয়ার কারণ কি প্রচারের অভাব না উদ্যোগটির বিষয়ে সচেতনতার অভাব? এ বিষয়ে অনীহা বা উপেক্ষারও কি ভূমিকা থাকতে পারে?

পাশাপাশি আর একটি মৌলিক প্রশ্ন উঠে আসছে। ১৯৯৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি আয়োগ বা ইউজিসি-র উদ্যোগে একটি স্বয়ংশাসিত সংস্থা তৈরি হয়েছিল, ন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল (ন্যাক)। এই সংস্থারও দায়িত্ব দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির মূল্যায়ন। তবে ন্যাক-এর মূল্যায়নের আওতায় আসে কেবল কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়। এনআইআরএফ-এর জাল অনেক বড়। তার মূল্যায়নের আওতায় কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও পড়ে এমন প্রতিষ্ঠান, যেখানে পড়ানো হয় ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যানেজমেন্ট, চিকিৎসাশাস্ত্র, ফার্মাসি, স্থাপত্যবিদ্যা, আইন। প্রশ্ন হল, দুটি মূল্যায়ন সংস্থাকেই কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মান যাচাই করতে দেওয়া কতখানি যুক্তিসঙ্গত? দুটি সংস্থার মাপকাঠির মধ্যে কি সামঞ্জস্য আছে? কী ভাবে ব্যাখ্যা করা হবে ফলের তারতম্য?

এনআইআরএফ-এর মাপকাঠিগুলো বলা হল। ন্যাক-এর মাপকাঠিগুলো এ রকম: পাঠ্যক্রমের গুণমান, শিক্ষণ এবং মূল্যায়ন, গবেষণা-উদ্ভাবন-সঞ্চরণ, পরিকাঠামো এবং শিক্ষণ-সম্পদ, ছাত্র-সাহায্য এবং অগ্রগতি, প্রশাসন-নেতৃত্ব-ব্যবস্থাপনা, আর প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যবোধ এবং সে সবের প্রয়োগ। মাপকাঠিগুলো খুঁটিয়ে দেখলে চোখে পড়বেই তাদের মধ্যে উদ্দেশ্যের ফারাক, ঝোঁকের ফারাক। এনআইআরএফ-এর চোখে প্রতিষ্ঠানের স্নাতকদের ‘আর্থিক সাফল্য’ই তার উৎকর্ষের মাপকাঠি। তারা চাকরির বাজারে কত মাইনে পাচ্ছে, তথ্যটি তাই গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এই বছরেই একটি প্রথম সারির আইআইটি থেকে স্নাতক হয়ে মোটা মাইনের হাতছানি উপেক্ষা করে গ্রামে কাজ করার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে গেলেন যে তরুণ, তাঁর সামাজিক অবদান স্বীকৃতি পেল না। বাদ পড়ে গেলেন সেই সব তরুণও, যাঁরা নামকরা প্রতিষ্ঠানে যোগ না দিয়ে নিজেরাই উদ্যোগপতি হয়ে গড়ে তুলছেন ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান।

তুলনায় ন্যাক-এর মাপকাঠি অনেকটা মানবিক। শিক্ষাকে টাকার অঙ্কে মাপার ব্যবস্থা এখানে নেই। কিন্তু স্কুল শেষের পরীক্ষা দিয়ে এক জন ছাত্র বা তার অভিভাবক কোন তালিকার ওপর নির্ভর করবেন কলেজ বাছার জন্যে? ন্যাক-এর মূল্যায়নে যে কলেজ তালিকার শীর্ষে, এনআইআরএফ-এর মূল্যায়নে তার জায়গা সতেরো নম্বরে!

আরও একটি বিপজ্জনক মাপকাঠি ন্যাক-এর মূল্যায়নে অনুপস্থিত: প্রতিষ্ঠান বিষয়ে ধারণা। এই ‘ধারণা’ বিষয়ে ধারণা করার জন্যে মতামত চাওয়া হয় বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়ী বা ‌উদ্যোগ প্রতিষ্ঠানের কাছে অর্থাৎ যারা চাকরি দেবে, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তাদের কাছে, আর সাধারণ মানুষের কাছে। প্রথম বর্গের মানুষরা সেই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই পছন্দ করবেন, যারা উপার্জন-প্রতিযোগিতা-অনুশাসন-আনুগত্যের মন্ত্রে দীক্ষিত ‘চাকরিযোগ্য’ মানবসম্পদ তৈরি করে। ও দিকে সাধারণ মানুষের মনে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিষয়ে ধারণা তৈরি হয় মিডিয়া-বাহিত তাৎক্ষণিক খবরের কল্যাণে। সে সবের স্থায়ী মূল্য সামান্যই। এই সব মতামতের ওপর নির্ভর করে প্রতিষ্ঠানের উৎকর্ষ যাচাই করলে তার সামাজিক মূল্য কতটুকু?

অবশ্য যাঁরা এই মূল্যায়ন-ব্যবস্থার কর্ণধার এবং পৃষ্ঠপোষক, মনে হয় না তাঁরা কোনও সুস্থ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল্য যাচাই করায় আগ্রহী। মন্ত্রী বলেছেন, এই তালিকার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানগুলো অন্যদের নিরিখে নিজেদের যাচাই করার সুযোগ পাবে। মন্ত্রকের সচিবের দাবি, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মান্য এমন অনেক তালিকার চেয়ে এই তালিকা বাস্তবসম্মত। সেই বাস্তবের মূলমন্ত্র— উচ্চশিক্ষা মানে প্রতিযোগিতায় বাজিমাত করা, আর সেই সব প্রতিষ্ঠানই উৎকৃষ্ট যারা বেশি টাকা কামাবে অথবা টাকা কামানোর শিক্ষা দেবে।

আক্ষরিক অর্থেই, অচ্ছে দিনে পণ্য হবে যা কিছু সব শিক্ষাগত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন