বছর বারো আগে ইলোরায় নাকে রুমাল বাঁধা এক বাঙালি পর্যটককে বলতে শুনেছিলাম: কৈলাসে বড্ড ব্যাটের গন্ধ! ব্যাট মানে বাদুড়। ঠিক এই আক্ষেপটাই করছিলেন ওয়ার্ধা শহরের হিন্দি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, থুড়ি, ‘কুলপতি’। ওঁরা সে-রকমই বলে থাকেন। এমনকী, এক ঘর অহিন্দিভাষী লোকের সামনেও ওঁরা ‘ভাইস-চ্যান্সেলর’ শব্দটা বলতে নারাজ। ওঁদের অভিযোগ, শুদ্ধ ভারতীয় ভাষা বলতে আমরা ভুলে যাচ্ছি, আমাদের কথার মধ্যে পাশ্চাত্য ইংরেজি ঢুকে পড়ছে ইত্যাদি। ‘কুলপতি’র কথায়, ‘‘এখন আমরা একটা গোটা বাক্য হিন্দিতে বলতে পারি না। মাথা টেপার আরজি জানালে ফোরহেড-এ ফিঙ্গার দিতে বলি। এটা ঠিক নয়। পরিষ্কার হিন্দি বলতে পারা জরুরি।’’
ভাষাবিজ্ঞান বা লিঙ্গুইস্টিক্সের জাতীয় আলোচনাচক্রে কথাগুলো যখন বলছিলেন তিনি, আপত্তি করলেন আইআইটি-র আমন্ত্রিত অহিন্দিভাষী গবেষক (ওঁদের ভাষায় ‘শোধার্থী’)। তাঁর বক্তব্য, দুই ভাষা মিলিয়ে-মিশিয়ে কথা বলাকে ভাষাবিজ্ঞানে ‘কোড মিক্সিং’ বলে। এটা কোনও ভ্যালু জাজমেন্ট-এর জায়গা নয়। এই শুনে আবার পালটা বক্তব্য এল মহারাষ্ট্রের এক অধ্যাপকের কাছ থেকে: ইংরেজির আগ্রাসনে হিন্দি তথা ভারতীয় ভাষা সংকটে। তাই তাকে আগলানো দরকার। ক্ষুব্ধ বক্তব্যের শেষে ‘জয় ভারত’ বললেন তিনি।
ভাষাবিজ্ঞানের তর্ক বাদ রেখে সাদা চোখেই হিন্দিপন্থী বক্তব্যের সমস্যাগুলো একে-একে দেখা যাক। এক, যে-কোনও ভাষাকেই রক্ষা করা দরকার। কিন্তু বাঁচানোর প্রশ্ন তো তখনই আসে, যখন সে-ভাষা বিপন্ন হয়। হিন্দি তো তেমন ভাষা নয়! বরং ২০০১ আদমশুমারি অনুসারে ভারতে ৪২ কোটি ২০ লক্ষ ৪৮ হাজার ৬৪২ মানুষের মাতৃভাষা হিন্দি, যা দেশের জনসংখ্যার ৪১.০৩ শতাংশ। দু’নম্বরে বাংলা। কিন্তু সংখ্যার নিরিখে বাংলার একেবারে জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার দশা। ৮ কোটি ৩৩ লক্ষ ৬৯ হাজার ৭৬৯। এমনকী, সারা বিশ্বে মাতৃভাষার নিরিখেও হিন্দির অবস্থান চার নম্বরে। কাজেই হিন্দিকে রক্ষা করা বা বাঁচানোর প্রশ্নটা আসছে কেন? ব্যাপারটা বরং এ-ভাবে ভাবা যেতে পারে— হিন্দিকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে হবে। সম্ভবত উদ্দেশ্য সেটাই। কারণ কাউকে শক্তি জোগাতে হলে, তাকে যদি বিপন্ন প্রমাণ করে দেওয়া যায়, তবে সমর্থন মেলে সহজে। রাষ্ট্র যে-ভাবে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে সব সময় শত্রু খাড়া করে রাখে, এ-ও সেই পদ্ধতি। দুই, ভারতে বিপন্ন ভাষার সংখ্যা ১৯৭ (ইউনেস্কোর হিসাব অনুসারে)। এর মধ্যে বহু ভাষাই হিন্দির কারণে বিপন্ন। হিন্দির আগ্রাসন এমন, যে বাংলার (আন্তর্জাতিক ক্রমে সাত নম্বরে যার স্থান) মতো শক্তিশালী ভাষাকেও সে আক্রমণ করে ফেলেছে। ‘কেন কী’ বা ‘লাগু’র মতো শব্দ আজ অনেকের মুখেই শোনা যায়। কিংবা ‘ঝেলেছি’ ক্রিয়াপদ! আর ‘কাশ’ শব্দটা যে ফুল ছাড়াও ব্যবহার করা যায়, তা-ই বা বাঙালি জানল কবে? হিন্দির দাপটই এ-সব জানিয়েছে। অর্থাৎ এ-দেশের কোন ভাষাগুলি বিপন্ন, কেন বিপন্ন, তা সহজেই অনুমেয়। তিন, বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে সেতু হিসাবে যে সাধারণ ভাষাটি ব্যবহৃত হয়, তাকে বলে ‘লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা’। এ-দেশের হিন্দির জায়গা তেমনই।
আলোচনাচক্র থেকে আর একটা পালটা গল্পও উঠে এল। খারিবোলি, আওয়াধি, বাঘেলি, বুন্দেলি, ভোজপুরিসহ কুড়িটিরও বেশি উপভাষা রয়েছে হিন্দির। সেই সমস্ত ভাষাভাষী মানুষদের হিন্দিভাষী বলেই গণ্য করা হয়। আজকাল দেখা যায়, তারাও নিজেদের ভাষা ভুলে হিন্দি বলছে। বা বলতে বাধ্য হচ্ছে। ঠিক যেমন পশ্চিমবঙ্গে কামরূপী বা ঝাড়খণ্ডী উপভাষা বলা মানুষেরা আজ গদ্য লেখার বাংলাতেই কথা বলেন, যার নাম মান্য বাংলা। তেমন হিন্দির উপভাষাগুলোও মান্যরূপে মিশে যাচ্ছে। সাইনবোর্ডে আর সরকারি দলিলের দাপটে। হিন্দি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভোজপুরি ভাষা নিয়ে কাজ করছেন এক গবেষক। তিনি জানালেন, হিন্দির হাত থেকে নিজের ভাষাকে বাঁচানোর জন্য কতটা লড়তে হয়। চাপা আগুনটা এই সব ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে জ্বলছে, যাদের খেয়ে ফেলছে হিন্দি। তাদের প্রতিবাদের ক্ষমতা নেই, তাই আগ্রাসন বাড়ছে।
এ-প্রসঙ্গে সর্বশক্তিমান রাজনীতির কথা আসবেই। ১৯৫০ সালে প্রচুর তর্কবিতর্কের পরে ইংরেজির পাশাপাশি হিন্দিকেও দেশের সরকারি ভাষা ঘোষণা করা হয়। পক্ষে ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। পনেরো বছর পর ইংরেজি তুলে দিয়ে শুধুই হিন্দি রাখার প্রস্তাব হয়। সেটা মানেননি অহিন্দিভাষীরা। প্রবল বিরোধিতায় সরব হয় তামিলনাড়ুর ডিএমকে। কাজেই শুধু-হিন্দির স্বপ্ন সরকারি ভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু ‘বেসরকারি’ ভাবে তা চলছে। এবং বাড়ছে।
যাঁরা শুদ্ধ হিন্দির নিদান দেন, তাঁরা শুদ্ধ শাকাহারী, এটা অবশ্যম্ভাবী। সত্যিই, চার দিন গেস্ট হাউসের পাতে ভুল করেও এক টুকরো ডিম পড়েনি। আমিষ খেতে হলে ক্যাম্পাসের গেটের বাইরে ধাবা আছে, সেখানে যান। ভাষাটা যে আসলে ধর্মের অঙ্গ, তা প্রমাণ করে খাদ্যাভ্যাস। বিশুদ্ধ ভাষা, বিশুদ্ধ খাবার, বিশুদ্ধ ধর্ম— জীবনযাপনকে এমন বিশ্বাসে মিলিয়ে দিতে পারলে ভারত-শাসন সহজ। সবাই তবে এক রকম ভাববে আর বলবে ‘জয় ভারত’। এই কারণেই চিনের মতো সুবৃহৎ দেশে একটাই টাইম জোন: বেজিং।
শেষে বলি এক গাড়োয়ালি যুবকের আক্ষেপ। ‘‘এখন গ্রামে সবাই হিন্দি বলে, মাতৃভাষা গাড়োয়ালি ভুলে যাচ্ছে। চাচা নেহরু বলেছিলেন, বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতিতে তো আজকাল সবটাই দেখছি ঐক্য!’’