George Floyd

কৃষ্ণাঙ্গের ইতিহাস

অধিকারের লড়াই সফল হইলেই যে সমদৃষ্টি বা সামাজিক ন্যায়ের নিশ্চয়তা মিলে না, আমেরিকায় ষাটের দশকের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের ইতিহাস তাহা দেখাইয়া দিয়াছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০২০ ০০:০১
Share:

সমস্যাটি নিছক কৃষ্ণাঙ্গের ইতিহাস লইয়া নহে। ছবি: সংগৃহীত

আটলান্টিকের দুই পারেই দাবি উঠিয়াছে: স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের আরও ভাল ভাবে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের ইতিহাস পড়াইতে হইবে। কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের নৃশংস হত্যার অভিঘাতে সেই দেশের সমাজে যে বিপুল আলোড়ন শুরু হয়, বিভিন্ন পরিসরে তাহার প্রতিক্রিয়া প্রবল। এই প্রতিক্রিয়ার দুইটি প্রধান মাত্রা: এক দিকে কালো মানুষের অধিকারের দাবি, অন্য দিকে তাঁহাদের প্রতি শ্বেতাঙ্গ সমাজের সমদৃষ্টির দাবি। অধিকারের লড়াই সফল হইলেই যে সমদৃষ্টি বা সামাজিক ন্যায়ের নিশ্চয়তা মিলে না, আমেরিকায় ষাটের দশকের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের ইতিহাস তাহা দেখাইয়া দিয়াছে। দেশের আইনে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের সমানাধিকার বহুলাংশে মিলিয়াছে, কিন্তু সামাজিক ন্যায় এখনও বহুলাংশেই অধরা। তাহার একটি প্রধান কারণ, বহু শ্বেতাঙ্গ নাগরিক আজও তাঁহাদের সমান মনে করেন না।

Advertisement

ছাত্রছাত্রীরা দেশের যে ইতিহাস পড়ে, তাহা প্রধানত শ্বেতাঙ্গের ইতিহাস, কালো বা বৃহত্তর ভাবে অ-শ্বেতাঙ্গ মানুষের অবস্থান সেখানে প্রান্তিক (যেমন ক্রীতদাস কিংবা সুযোগবঞ্চিত ও অনগ্রসর বর্গ হিসাবে) অথবা ব্যতিক্রমী, যথা বারাক ওবামা। এই অপূর্ণ ইতিহাসের শিক্ষা নাগরিকের বোধকেও অপূর্ণ করিয়া তোলে। ক্ষমতার বলয়ে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের সহিত এই মানসিক অপূর্ণতার সমাহারে তৈরি হয় সন্দেহ, বিরাগ ও বিদ্বেষের গরল। তাহার বিক্রিয়ায় ক্ষমতাবান শ্বেতাঙ্গ ক্ষমতাহীন কৃষ্ণাঙ্গকে বেমালুম নিপীড়ন করিতে পারে, কারণ সে তাহাকে ‘অপর’ বলিয়া গণ্য করে। শিক্ষাবিদদের একাংশের মতে, এই বিকৃত ধারণাকে শুদ্ধ করিতে চাহিলে পাঠ্যসূচি ও তাহা পড়াইবার পদ্ধতিতে ভারসাম্য আনা জরুরি, যাহাতে মানুষ শিশুকাল হইতে দেশের ইতিহাসকে সমস্ত বর্ণের মানুষের সম্মিলিত জীবনযাত্রার ইতিহাস হিসাবে চিনিতে শিখে। লক্ষণীয়, এই দাবি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ব্রিটেনেও প্রবল হইতেছে। বৃহত্তর ইউরোপেও এই সমস্যা অপরিচিত নহে। তবে এ ক্ষেত্রে ব্রিটেনের বৈশিষ্ট্য অনস্বীকার্য। ব্রিটিশ সমাজ ও রাজনীতি বহু সংস্কৃতির সমান মর্যাদা বিষয়ে বিশেষ ভাবে সংবেদনশীল। সেই বহুসাংস্কৃতিক ব্রিটেনেও ছাত্রছাত্রীদের যে বিশেষ ভাবে কৃষ্ণাঙ্গের ইতিহাস পড়াইবার দাবি তুলিতে হইতেছে, তাহা সমস্যার গভীরতাকে চিনাইয়া দেয়।

সমস্যাটি নিছক কৃষ্ণাঙ্গের ইতিহাস লইয়া নহে। ভারতে প্রচলিত ইতিহাস-শিক্ষায় মুসলমান সম্প্রদায় এবং তথাকথিত ইসলামি যুগের ধারণা যে ভাবে ছাত্রদের মস্তিষ্কে বপন ও লালন করা হয়, সমাজে সাম্প্রদায়িক চেতনার বিস্তারে তাহার প্রভাব বিস্তর। আবার, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে উচ্চবর্ণের সামাজিক আধিপত্য তাহার ইতিহাসের পাঠ্যসূচিতেও প্রবল ভাবে প্রতিফলিত— নিম্নবর্গের বাঙালিরা, বিশেষত অ-বাংলাভাষীরা, বঙ্গীয় ইতিহাসে কার্যত অনুপস্থিত, ফলে ‘শিক্ষিত’ বাঙালির চেতনাতেও। দেশ জুড়িয়া এমন দৃষ্টান্ত বিস্তর। এবং, ভারতের বর্তমান সংখ্যাগুরুবাদী শাসকরা এই সমস্যাকে বহুগুণ বাড়াইয়া তুলিতেছেন। ‘ইতিহাস বিজয়ীরাই লেখে’— এই ঐতিহাসিক বাক্যটিকে তাঁহারা বিকট উৎসাহে সত্য প্রমাণ করিতে তৎপর। কৃষ্ণাঙ্গের ইতিহাস শিক্ষা এ দেশেও অত্যন্ত আবশ্যক। কৃষ্ণাঙ্গ কেবল গাত্রবর্ণের ব্যাপার নহে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন