হিন্দু অতীতের এই মোহ আমাদের দুশ্চিন্তায় ফেলে

প্রাসাদনগরীটি দেখলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। প্রতাপ আর সমৃদ্ধি ঠিকরে বেরোচ্ছে। রাজন্যবর্গের দেব-দ্বিজে কী বিপুল ভক্তি! তবে সে দেবতা শীতলা, মনসা, শনি, এমনকী পাড়ার ক্লিষ্ট শিবমন্দিরটির সঙ্গে তুলনীয় নয়। দেখলেই মনে হবে, ‘দেব হো তো অ্যায়সা।’

Advertisement

বিশ্বজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৭ ১৩:০০
Share:

বীরত্ব: মধ্য কলকাতায় রানা প্রতাপের মূর্তি । ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

প্রাসাদনগরীটি দেখলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। প্রতাপ আর সমৃদ্ধি ঠিকরে বেরোচ্ছে। রাজন্যবর্গের দেব-দ্বিজে কী বিপুল ভক্তি! তবে সে দেবতা শীতলা, মনসা, শনি, এমনকী পাড়ার ক্লিষ্ট শিবমন্দিরটির সঙ্গে তুলনীয় নয়। দেখলেই মনে হবে, ‘দেব হো তো অ্যায়সা।’ বিপুলায়তন গণেশ। তাঁর পায়ের তলায় প্রমত্ত হস্তী শান্ত হয়ে বসে পড়ছে। স্ফটিক নির্মিত শিবলিঙ্গ, কী তার ঐশ্বর্য! এই হিন্দুরাজ্যে যুদ্ধে ও অপরাপর কার্যে ব্যবহৃত পশুদের শরীর দেখলেও আনন্দ হয়। শুধু এ রাজ্যে কেন, ছোটখাটো হিন্দুরাজ্যের গোরুর পাল ধুলো উড়িয়ে শিঙে আগুন জ্বালিয়ে যখন শত্রুপক্ষের দিকে ধেয়ে যায় তখন মনে হয়, বাবা! কোথায় লাগে ঘোড়া! আর এই দেবতাদের মান্য করে ন্যায়ের শপথ গ্রহণকারী নারী-পুরুষের কী রাজসিকতা! বাহুবলের সঙ্গে মিশেছে বুদ্ধি আর রণকৌশল। ‘বিজ্ঞান-প্রযুক্তি’র সম্ভব-অসম্ভব স্পর্শ লেগেছে। সেই হিন্দুরাজ্যে আছে একই সঙ্গে জলে চলা আকাশে ওড়া ময়ূরপঙ্খী নৌকা। প্রয়োজনে প্রকৃতির সম্পদকে বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি দিয়ে কাজে লাগাতে পারেন তাঁরা। এক পায়ে খাড়া গাছকে পোল ভল্টের দণ্ডের মতো ব্যবহার করে বিশাল প্রাকার ও প্রাচীর ডিঙিয়ে ফ্যাৎ ফ্যাৎ সাঁই সাঁই উড়ে গিয়ে রাজপ্রাসাদের মধ্যে ঢোকেন নায়ক মহেন্দ্র বাহুবলী। তাঁর বাবা অমরেন্দ্রও ছিলেন যুদ্ধবিদ্যা ও ইঞ্জিনিয়ারিং বুদ্ধিতে অতুলনীয়। এক সঙ্গে তিনটি তিরে লক্ষ্য ভেদ করতেন, জলাধারের বাঁধ খুলে দিয়ে দস্যু সৈন্যকে ধুয়ে দিতেন। রাজ্য থেকে নির্বাসিত হওয়ার পর নিজের পরিকল্পনায় পত্তন করেছিলেন নতুন বাসস্থান। আর অমরেন্দ্রর স্ত্রী দেবসেনা! বীর্যশুক্লা তিনি। যেমন রূপ তেমন ধনুর্বিদ্যায় পারদর্শী। ছুটন্ত বন্য শূকরের পেছনে রথারোহী রমণী, দুরন্ত তির নিক্ষিপ্ত হচ্ছে তাঁর ধনুক থেকে। বড় পরদায় এই সব দেখে গোটা দেশ হতবাক— হিন্দুভারতের বীরত্ব, সমৃদ্ধি, ভক্তি, রণকৌশল দেখে গর্বে বুক ভরে উঠছে। বলতে ইচ্ছে করছে, ‘বাহুবলী, বাহুবলী, বাহুবলী। দেবসেনা, দেবসেনা, দেবসেনা। হিন্দুভারতের শৌর্য-বীর্য অতুলনীয়।’ সেই অতীতের গর্বে বর্তমানের সিনেমা হল ভরছে, উপচে পড়ছে দর্শক। সিনেমালব্ধ ধনের একাংশ নাকি ব্যয় করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা রক্ষায় ‘শহিদ’ সেনাদের পরিবারের জন্য। অতীতের হিন্দুরাজ্যের গর্বে বলীয়ান দর্শক বর্তমান রাষ্ট্রের সেনাশহিদদের জন্য পরোক্ষে অর্থব্যয় করছেন।

Advertisement

এই বাহুবলী হিন্দুরাজ্যের দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের গল্প দেখতে দেখতে অবধারিত ভাবে মনে পড়ে যায় বাবু বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথা। উনিশ শতক, সাহেবরা তখন এ দেশে গুছিয়ে বসেছেন। এসে পর্যন্ত অধিকাংশ সাহেব হিন্দু পুরুষদের নিয়ে রংতামাশা করেন। মেকলে হিন্দুপুরুষদের মেয়েলিপনা, শারীরিক দুর্বলতা নিয়ে তীব্র মন্তব্য করেছেন। লেখক বঙ্কিমের আক্ষেপ— ‘এফেমিনেট হিন্দুজ’ সাহেবদের মুখে লেগেই আছে। হিন্দুদের মেয়েলিপনার অভিযোগ কী ভাবে খণ্ডন করা যায়? ‘বাঙ্গালীর বাহুবল’ নামে প্রবন্ধ লিখতে হল ডেপুটি বঙ্কিমকে। জানাতে হল, বাঙালির বাহুবল না থাক, হিন্দুদের বাহুবল ছিল। ‘মৌর্যবংশীয় ও গুপ্তবংশীয় সম্রাটেরা’ বঙ্কিমের মতে হিমাচল থেকে নর্মদা পর্যন্ত একচ্ছত্রে শাসন করেছিলেন। মুসলমান আগমনের আগে হিন্দুদের সেই বাহুবলের কল্পনায় ও বিবরণে বাবু বঙ্কিম ভারতকলঙ্ক দূর করতে চান। শুধু প্রবন্ধে হবে না, চাই উপন্যাস— পাঠককে তা রুদ্ধশ্বাস বিনোদন দেবে, হিন্দুর বাহুবলে আস্থাশীল করবে।

বঙ্কিম লিখেছেন রাজস্থানের পার্বত্যপ্রদেশে রূপনগর নামে এক রাজ্য ছিল। সেই রাজ্যের রাজকন্যা চঞ্চলকুমারী। কী তার দর্প, দিল্লির বাদশাহের ছবিতে সে লাথি মারতে দ্বিধা করে না। চঞ্চলকুমারীর আরাধ্য হিন্দুকুলপতি রাজসিংহ। মুঘলের কাছে সেই হিন্দু রাজা পরাভূত হয়েছিলেন, এ-কথা ইতিহাস বলে। ইতিহাসের সেই ফল বঙ্কিম বদলে দিতে পারেন না বটে, তবে রাজসিংহের রণকৌশল ও রণপাণ্ডিত্যের পরিচয় দিতে তিনি ছাড়বেন কেন! রাজসিংহের সৈন্যসংস্থাপনের গুণে বাদশাহ আলম্‌গীরের অনুগামীদের এক সময়ে নাজেহাল দশা হয়েছিল। সে বিবরণ বঙ্কিম দেন শতমুখে। বঙ্কিম তাঁর রাজসিংহ উপন্যাসের চতুর্থ সংস্করণের ভূমিকায় লিখেইছিলেন, ‘হিন্দুদিগের বাহুবলই আমার প্রতিপাদ্য। উদাহরণ স্বরূপ আমি রাজসিংহকে লইয়াছি।’ এই রাজসিংহ পৌরাণিক কৃষ্ণের আদলে নির্মিত। ‘বাহুবলী দুই’-এর পরিচালক রাজামৌলিও এই ২০১৭-তে একই ভাবে বলতে পারেন, ‘হিন্দুর বাহুবল দেখানোর জন্য আমি অমরেন্দ্র ও মহেন্দ্র বাহুবলীকে নিয়েছি।’ দেবরাজ ইন্দ্রের মতোই বীর তাঁরা, কৃষ্ণের মতোই প্রেমিক, তবে বহুগামী নন, একগামী। আদর্শ পতি। আর যুদ্ধবাজ বঙ্কিমী মেয়েরা? সিনেমার দেবসেনার মতোই। ঘোড়ায় চেপে আনন্দমঠের শান্তি যুদ্ধে যায়, ঘরের বউ প্রফুল্ল শিক্ষা ও অনুশীলনের গুণে দেবী চৌধুরাণী হয়ে ওঠেন। একই হাতে তিনি সুর তোলেন, প্রয়োজনে অস্ত্র ধরেন। অমরেন্দ্রর বউ দেবসেনা গানও গায়, তিরও নিক্ষেপ করে। বাঙালি উপন্যাস-পাঠক হিন্দুদের এই বাহুবলী অতীতের কথা উনিশ শতকে গোগ্রাসে পড়ত। বিশ শতকে তাঁদের জন্য কলম ধরেছিলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। হিন্দুর পরাজয়কে অস্বীকার করার উপায় নেই, কিন্তু হিন্দুর রণচাতুর্যকে দেখাবেন না কেন? বঙ্কিমের চেয়েও পুরনো অতীত তাঁর কলমে রূপ পেল। দক্ষিণ ভারতের হিন্দুরাজ্যের সমৃদ্ধি ও বীরত্ব তাঁর উপন্যাসের বিষয়। চাইলে কেউ ধরে ধরে শরদিন্দুর উপন্যাসের উপাদানের সঙ্গে বাহুবলীর উপাদানের মিল দেখাতে পারেন। উপন্যাসের সেই বিনোদন-ভূমিকা দখল করেছে পরদা।

Advertisement

কেউ বলতেই পারেন, মিনমিনে মেয়েলি হিন্দুকে নিয়ে সাহেবি অপপ্রচার রুখতে পরাধীন ভারতে নায়কোচিত আত্মগর্বী হিন্দুর দরকার ছিল, এই একুশ শতকেও তো দরকার বাহুবলের, কর্মময়তার। এবং শুধু বাহুবল দিয়ে হবে না, বৈজ্ঞানিক যুক্তি আর প্রযুক্তির বুদ্ধিও কাজে লাগাতে হবে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা রক্ষার জন্য চাই বাহুবলী হুঙ্কার ও প্রযুক্তির সহযোগ। মিনমিনে ভদ্র প্রধানমন্ত্রীর বদলে চাই একবগ্‌গা তৎপর প্রধানমন্ত্রী। এই চাওয়াটা যে ভারতের অজস্র মানুষের মনে সুপ্ত ও প্রকাশ্য তা রাজনীতিতেও স্পষ্ট, পর্দাতেও। ২০১৫-য় বাহুবলী এক যে স্বপ্নের সূত্রপাত করেছিল, ২০১৭-য় বাহুবলী দুই সেই স্বপ্নকে পরিণতি দিল। এই সমৃদ্ধি-রাজসিকতাই তো রাষ্ট্রের কাম্য। আমরা তা না চাইলেও অপর রাষ্ট্র তা চায়, সুতরাং আমাদেরও চাইতে হবে। আমরা চাইতে বাধ্য। এই চাওয়ার সঙ্গে হিন্দুরাজ্যের কল্পনা কেমন একাকার হয়ে যাচ্ছে।

হিন্দুরাজ্যের এই উপযোগবাদী সমৃদ্ধ কল্পনার সামনে দাঁড়িয়ে তবু একটা কথা মনে হয়। বঙ্কিম রাজসিংহ উপন্যাসের শেষে পাঠকদের কাছে একটি নিবেদন করেছিলেন। লিখেছিলেন, হিন্দু হলেই ভাল হয় না, মুসলমান হলেই মন্দ হয় না। জানিয়েছিলেন, ‘অনেক স্থলে মুসলমানই হিন্দুর অপেক্ষা রাজকীয় গুণে শ্রেষ্ঠ। অনেক স্থলে হিন্দু রাজা মুসলমান অপেক্ষা রাজকীয় গুণে শ্রেষ্ঠ।’ এই বিধিসম্মত সতর্কীকরণ ছিল, তবু একের প্রতি অপরের বিদ্বেষ রোখা যায়নি। বাহুবলীতে হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব নেই, সেখানে শুধুই হিন্দু-শাসনের রূপ-গুণ কীর্তন। তবে বাহুবলীতে মুগ্ধ আমজনতা, হিন্দুসমৃদ্ধির গল্পকে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে বলীয়ান হয়ে ভারতবর্ষের একমাত্র গল্প বলে ভাবতে চান, অন্যস্বরকে নিকেশ করতে চান, একচ্ছত্রে সবাইকে দখল করতে চান! তখন বিপদ। উপযোগবাদী সমৃদ্ধির সংস্কৃতির অংশীদার হলে হয় তুমি বন্ধু, না হলেই শত্রু।

অনাহত যবন-আক্রমণ-পূর্ব হিন্দু অতীতের কল্পনা আমাদের তৃপ্তি দেয়, আবার এই হিন্দু অতীতের মোহ আমাদের ভারতের পরবর্তী ইতিহাসকে সমৃদ্ধ হিন্দুর পরাজয়ের ইতিহাস বলেই দেখতে শেখায়। ভাবায়, সেই সমৃদ্ধ হিন্দু রাজ্যের মতো আমাদের দেশকেও সমৃদ্ধ হিন্দুর দেশ করে তুলতে হবে। এই ভাবনা থেকে জন্ম নিতে পারে প্রতিহিংসার বোধ, উপনদী ও শাখানদীর বিস্তারে প্রবহমান বর্তমানের নদীকে অতীত গতিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার আত্মঘাতী জেদও মাথা তুলতে পারে। যা সুপ্ত, তা যে কখন প্রকাশ্যে আসে!

বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন