দোলের সকালে, এই প্রথম রোজকার দেখা আলো পাল্টে গেল

বুঝতে পারলুম, আকাশের লাল আমার গালে আর বুকের মধ্যে ওটা কি তারসানাই? লিখছেন উর্মিমালা বসুদোলই লাগে, দোলাও। চলে যাবার দল যে কোথা থেকে প্রথমে উঁকিঝুঁকি, তারপর ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে আসন পেতে আড্ডা জমাতে শুরু করে বুঝে উঠতে পারি না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০১৯ ০০:০০
Share:

অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস

দোল, দুর্গোৎসব নিয়ে খুব বাড়াবাড়ি করার স্মৃতি নেই, কিন্তু কিছু কিছু উপলক্ষ যেগুলো নিজের অগোচরেই মনের অগমে বাসা বেঁধে আছে, সেটা সে সময়ে না বুঝলেও এখন বুঝি। বসন্তের এই বিবশকারী অনুভব কোকিলের ডাকে বা মাতাল সমীরণেই আসে এ কথা আমি হলফ করে বলতে পারি না। চৈত্রের দুপুরের একঘেয়ে আলস্যে, পাতাঝরার প্রাচুর্যেও তাকে পাই। বিকেল আর সন্ধের মালাবদলের সময়টিও অনেক সময় যে অতল ভাললাগা আর বিষাদের জন্ম দেয় মনের মধ্যে তা দ্বার খোলার কথা বলে, বলে ‘লাগলো যে দোল।’

Advertisement

দোলই লাগে, দোলাও। চলে যাবার দল যে কোথা থেকে প্রথমে উঁকিঝুঁকি, তারপর ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে আসন পেতে আড্ডা জমাতে শুরু করে বুঝে উঠতে পারি না। আবার যখন বুঝি, তখন তাদের ছেড়ে দেওয়াও অসম্ভব হয়ে ওঠে।

আমাদের ছোটবেলায় দোল আসতো দোলের এক পক্ষকাল আগে থেকে। হিন্দিভাষী প্রতিবেশীদের সন্ধে থেকে গোল হয়ে বসে একটা টং টং আওয়াজ করা বাদ্যযন্ত্র আর ঢোলক সহযোগে হোলির গানে আর মাঝে মাঝে মাথার ওপর আবির উড়িয়ে ‘হোলি হ্যায়’ উচ্চারণে। সাধারণত, পাড়ার পানের দোকানের সামনে বা গলির মোড়ে এই পথচলতি আসর বসতো। দুপুরবেলার ছাতুওয়ালা সন্ধেবেলার এই আসরে মূল গায়েনের পদাভিষিক্ত হয়ে আবির মাখা মুখে অন্য মানুষ হয়ে যেতেন। সবাই বলতো, ওরা ভাঙ খেয়ে নেশা করে। ও সব জানি না, কিন্তু অমন ‘আপনহারা মাতোয়ারা’ পাবলিক আমি অদ্যাবধি বিশেষ দেখিনি। দোলের আগের বিকেলটায় আবার পাড়ার ছেলেবুড়ো দলবেঁধে সমস্বরে ‘আজ আমাদের ন্যাড়াপোড়া কাল আমাদের দোল’ বলে গাছের ডাল, ছেঁড়া পুতুলের মুণ্ড, বস্তা, কাঠ, খড়, ফেলে দেওয়া চটিজুতো— কি না জড়ো করে বহ্নি উৎসব। দোলের সকালে ঘুম ভাঙতো খোল করতাল আর সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরা সুভদ্র প্রতিবেশীদের কীর্তনের আওয়াজে। দৌড়ে বারান্দায় বা জানলায় দাঁড়িয়ে দেখতুম ফুটকলাই, কদমা, রংবেরঙের এর মট আর খইয়ের মতো সাদা চিনির মুড়কি ছড়াতে ছড়াতে ছেলে-বুড়োর দল চলেছে কীর্তনের মায়া জাগিয়ে।

Advertisement

অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস

আমার শ্বশুরবাড়ির পাড়ায়, টালাপার্কে আবার বুধেদের মেলা। সেখানে জগন্নাথের কাছে শুনেছি, শ্রদ্ধেয় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে ওই অঞ্চলের বাঘা বাঘা সাহিত্যিকরা যেতেন তাঁকে প্রণাম করতে, নৈশভোজের ব্যবস্থা থাকতো। কে ছিলেন না সেই দলে! তরুণ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, বিমল কর, গৌরকিশোর ঘোষ, আরও অনেকে ছিলেন। এ দিকে শিল্পী অন্নদা মুন্সীর বাড়িতে বসতো রঙের হাট, তাতে সাহেব-মেমরাও যোগ দিতেন, টালা ঝিলে স্নান সেরে মধ্যাহ্নভোজনে। তরুণতর সঙ্গীতপ্রেমীর দল খোল করতাল সহকারে কীর্তন গেয়ে পাড়া পরিক্রমা করতেন, উৎসাহী প্রতিবেশীরা সেফটপিন দিয়ে টাকা লাগিয়ে তাঁদের সম্মানিত করত।

কয়েক দিন আগে কানে হেডফোন লাগিয়ে ‘তব প্রেম সুধারসে’ গানটি শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, চারিদিকের তুমুল বসন্ত আবাহনে এই ‘সুধারস’টিই কি অনুপস্থিত? হ্যাঁ, এই সব জমায়েতে কোনও মেয়েদের দেখিনি কখনও। তাদের দাপট ছিল অন্দর মহলে। ঘরের বউদিদিটি দেওরের কাছে হেরে যাবার জন্য বসে থাকতো অধীর আগ্রহে। আবির ছোপানো চিঠির আশায় রাঙা হয়ে উঠতো একলা যাপনে নববধূটি।

বাড়িতে দাদারা (তারাও ছোট তখন) বেলা হলে পাড়ায় যেত দোল খেলতে, ফিরতো বাঁদুরে রং মেখে। মা পিঠে নয়, সর্বাঙ্গে আড়ং ধোলাই দিয়ে রং তুলে দিতেন। সন্ধেবেলা পাড়ার সবথেকে কালকুলো ছেলেটাকেও তার মায়ের হাতের গুণে ফর্সা ফর্সা দেখাতো।

এই ভাবে দিন যায়। এরই মধ্যে ‘হঠাৎ আসে একটি সকাল’, দোলের সকাল, অন্য হাওয়া নিয়ে। এত দিন নীল দিগন্তে ফুলের আগুন লাগতে দেখেছি, এই প্রথম একটি সকালে রোজকার দেখা আলো পাল্টে গেল। যার সঙ্গে রোজকার হুটোপাটি, কাড়াকাড়ি, সে যখন পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমালে মোড়া সুগন্ধি আবির মাথায় ছিটিয়ে দিল, আয়না না দেখেই বুঝতে পারলুম, আকাশের লাল আমার গালে আর তার সঙ্গে বুকের মধ্যে ওটা কি তারসানাই?

তার পর কত রংবদল, পথ হারানো, দিকবদল, কত বাঁক। এখন নীল দিগন্তে ‘বেদন’ বাজে, ‘অনেক কালের মনের কথা জাগে’। কখনও আমহার্স্ট স্ট্রিটে, কখনও টালাপার্কে, কখনও শান্তিনিকেতনে যে মেয়েটিকে দেখতে পাই, সে আমারই নানা আমি। যে আমি কখনও ধরা দেবার জন্য সর্বস্বান্ত, কখনও রাজহংসী কখনও বা আতুর।

একটি গোপন প্রেমের ছবি মনে পড়ে, আমাদের এক বৌদি গৃহদেবতাকে আবির দিয়ে, বরের পায়ে আবির ছোঁয়াচ্ছেন,আর দাদা সলজ্জ বৌদির চিবুকে আবির দিয়ে কপালে আদর করছেন। সেই বৌদি আজ স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছেন। মনে পড়ে সুনীলদাকে, বইমেলার মতো শান্তিনিকেতনের দোলও তার রং হারিয়েছে। দেখতে পাই, চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে অনিন্দ্যদার বাগান, অর্ঘ সেন গাইছেন, ‘ও আমার চাঁদের আলো’...মরছি হাজার মরণে।

আমি কোনও দিনই রং খেলিনি, কিন্তু এখন খেলি। সে খেলা ‘কত রঙের লুকোচুরি, কত ঘরের কোণে।’ দোলের যে সব স্পর্শ আজ সব দেখার বাইরে চলে গেছে, যে সব ছোঁয়ার জন্য আজও আকুল হয়ে আছি তারা দোলায়। তাই সেই গানটি দিয়েই বলতে হয়, ‘কেউ বলে ফাল্গুন, কেউ বলে দখিনা, কেউ বলে পলাশের মাস, আমি বলি আমার সর্বনাশ।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন