আর্মি ডে প্যারেডে সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়ত। ছবি: পিটিআই।
যে কোনও মানবিক পরিসরেই খোলা হাওয়ার প্রবাহ ইতিবাচক, জরুরিও। দরজা-জানালাগুলো তার জন্য খোলা থাকা দরকার। কিন্তু সেনাপতি তাঁর দুর্গপ্রাকারের সব রন্ধ্রপথ বন্ধ করার হুকুম দিয়েছেন। বেবাক অকারণে এমন হুকুম জারি হয়েছে, তা বলা যাবে না হয়তো। কিন্তু সেনাপতির এই হুকুম আলো-হাওয়ার পথটা আগলে দাঁড়াতে পারে, এমন আশঙ্কাও তৈরি হচ্ছে।
ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর অন্দরমহল কয়েক দিন ধরে টালমাটাল। একের পর এক অভিযোগের ধাক্কায় কিছুটা বেসামাল। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাহিনীর বেশ কয়েক জন সদস্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও পোস্ট করে নানা অভাব-অভিযোগের কথা তুলে ধরেছেন। আর তার জেরে যে পরিস্থিতিটার জন্ম হয়েছে, সেই পরিস্থিতির দুটো পৃষ্ঠা।
প্রথম পৃষ্ঠা পড়লে মনে হচ্ছে, নিজেদের কথা সোশ্যাল মিডিয়ায় না বলে উপায় ছিল না জওয়ানদের। কারণ, অভিযোগ উঠেছে যে জওয়ানদের ঠিক মতো খেতে দেওয়া হচ্ছে না, প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, বেশ কিছু অবাঞ্ছিত কাজও করানো হচ্ছে।
দ্বিতীয় পৃষ্ঠা পড়লে মনে হচ্ছে, জওয়ানরা যা করেছেন, তা চূড়ান্ত শৃঙ্খলাভঙ্গের সামিল। অভাব-অভিযোগ যেমন রয়েছে, তেমন তার নিবারণের নির্দিষ্ট প্রক্রিয়াও রয়েছে। বাহিনীর নিজস্ব সেই প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে অভ্যন্তরীণ বিষয় সর্বসমক্ষে এনে ফেলা সর্বৈব অনুচিত হয়েছে।
এই পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে দেশের সেনাপ্রধানের কঠোর বার্তা, অভাব-অভিযোগ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আর একটিও পোস্ট বরদাস্ত করা হবে না। নির্দেশ অমান্য করলে কঠোর শাস্তি হবে।
সেনাপ্রধানের মতো দায়িত্বশীল ব্যক্তি যখন এমন নির্দেশ জারি করছেন, তখন ধরে নিতে হবে যে তিনি উদ্ভুত পরিস্থিতির দুটো পৃষ্ঠাই পড়ে নিয়েছেন এবং তার ভিত্তিতেই নির্দেশ দিয়েছেন। সেনাপ্রধানের কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট যে তিনি বাহিনীর শৃঙ্খলায় বিন্দুমাত্র আঁচড় সহ্য করবেন না। কিন্তু অভিযোগকারী জওয়ানদের যন্ত্রণার প্রতি তিনি আদৌ সহানুভূতিশীল কি না, সেনাপ্রধানের কণ্ঠস্বর থেকে তা একটুও স্পষ্ট হল না।
জওয়ান হন বা পদস্থ আধিকারিক, সেনাপ্রধান সকলের অভিভাবক। প্রত্যেকের প্রতি তাঁর সমান দায়বদ্ধতা। বাহিনীর শৃঙ্খলা রক্ষা করতে তিনি যতটা দায়বদ্ধ, সেনা পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের স্বার্থরক্ষা করতেও তিনি ততটাই দায়বদ্ধ। শৃঙ্খলা রক্ষার তাগিদে তিনি সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারে রাশ টানতে চাইছেন বোঝা গেল। কিন্তু যে কারণে আজ জওয়ানদের সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট এবং এত শোরগোল, সেই কারণগুলোর অবলুপ্তি ঘটাবেন এমন কথা হলফ করে বললেন কোথায়?
সেনাপ্রধান তাঁর বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, অভিযোগের কথা জানানোর জন্য বাহিনীতে অনেকগুলো স্তর রয়েছে। কিন্তু যাঁরা সোশ্যাল মিডিয়াতে আজ ক্ষোভ উজাড় করে দিয়েছেন, তাঁরা বিচার পাওয়ার জন্য এক বারও কি সেই সব দরজাগুলোয় কড়া নাড়েননি? পরিস্থিতি কি সত্যিই দুর্বিষহ না হয়ে উঠলে একটা আশিরনখ শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনীর সদস্যরা হঠাৎ এমন বেসুরে গাইতে সুর করেন? এই প্রশ্নগুলো কিন্তু উঠছে। এই প্রশ্নগুলোর জবাব দেওয়ার দায়ও কিন্তু সেনাপ্রধানকেই নিতে হবে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় আর পোস্ট নয়— সেনাপতির এ হুকুমে দুর্গপ্রাকারের অনেকগুলো দরজা-জানালা হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে। শৃঙ্খলাভঙ্গের কোনও দূষিত নিঃশ্বাস হয়তো আর বাতাসে মিশবে না। কিন্তু ভ্রমটাকে রোখার জন্য দ্বার বন্ধ করে দিলে, সত্যের যাতায়াতের পথে কাঁটা বিছিয়ে যাবে না তো? ভেবে দেখা দরকার সেনাপতি।