ছাড়পত্র

বাঁকুড়ার বড়জোড়ার এক পঞ্চায়েত সদস্য নাবালিকা কন্যার বিবাহ দিতে ‘ছাড়’ দাবি করিয়াছেন। ইহাতে মর্মস্থল অবধি স্পষ্ট হইল। প্রথমে বিস্ময় জাগিতে পারে— নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কী করিয়া আইনের শাসনে ব্যতিক্রম আশা করিতে পারেন?

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৮ ০১:৩৮
Share:

প্রতীকী ছবি।

আয়না নহে, এক একটি সংবাদ যেন রঞ্জনরশ্মি। সমাজের অস্থিপিঞ্জর সকলই দেখাইয়া দেয়। বাঁকুড়ার বড়জোড়ার এক পঞ্চায়েত সদস্য নাবালিকা কন্যার বিবাহ দিতে ‘ছাড়’ দাবি করিয়াছেন। ইহাতে মর্মস্থল অবধি স্পষ্ট হইল। প্রথমে বিস্ময় জাগিতে পারে— নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কী করিয়া আইনের শাসনে ব্যতিক্রম আশা করিতে পারেন? কিন্তু বিস্ময়ের কিছুই নাই, ইহাই আজ স্বাভাবিক। ক্ষমতাসীন দলের সদস্য হইলে উচ্চতম মন্ত্রী হইতে নিম্নতম দলীয় কর্মী, সকলেরই আইনের শাসন হইতে ‘ছাড়’ মিলিয়া যায়। যদি কেহ তাহাতে সন্দেহ করে, তাহার ভুল ভাঙিতে সময় লাগে না। ট্রাফিক পুলিশ চড় খাইয়া শিখিয়াছে, নেতাদের গাড়ি গতিসীমা লঙ্ঘন করিতে পারে। থানার পুলিশ টেবিলের তলায় ঢুকিয়া বুঝিয়াছে, শাসক দলের নেতার তাণ্ডবে বাধা দেওয়া অপরাধ। অগণিত মানুষ দুর্বৃত্তদের হাতে প্রাণ হারাইয়া বুঝিয়াছে, রাজনৈতিক প্রশ্রয়ের পরিধিতে আইনের প্রবেশ নাই। নির্বাচনী হিংসার সম্মুখে পুলিশ-প্রশাসন যে রূপ কানে তুলা দিয়া, চক্ষু মুদিয়া দাঁড়াইয়া ছিল, তাহাতে আইনে ‘ছাড়’ পাইবার শর্ত ও প্রক্রিয়া একেবারে স্বচ্ছ হইয়া গিয়াছে। এই কারণেই জলপাইগুড়ির একটি স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্ররা শনিবার পরীক্ষায় টোকাটুকিতে ‘ছাড়’ দাবি করিয়াছে।

Advertisement

সমাজে আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি স্পষ্ট করিয়াছে ওই সংবাদ, দেখাইয়াছে রাজনীতির অবস্থানও। সংবাদে প্রকাশ, বাঁকুড়ার পঞ্চায়েত সদস্য ওই পিতা প্রথমে সিপিএম, পরে তৃণমূল কংগ্রেস দল হইতে পঞ্চায়েতে পদ পাইয়াছেন। অসরকারি সংস্থা নাবালিকা-বিবাহে বাধা দিলে তিনি রাজনৈতিক সহকর্মীদের সহায়তাও প্রার্থনা করিয়াছিলেন। অর্থাৎ, রাজনৈতিক দলগুলির তরফে নাবালিকা বিবাহকে অনভিপ্রেত বলিয়া দেখিবার কোনও ইঙ্গিতই নাই। এই রাজ্যে সমাজ-সংস্কৃতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাজনীতি প্রবেশ করিয়াছে বহু বৎসর। স্থানীয় নেতাদের অনুমতি না মিলিলে কেহ বাড়ি সারাইতে পারে না, জমি বিক্রয় করিতে পারে না। কিন্তু নাবালিকা কন্যার বিবাহে বাধা দিতে কোনও নেতাকে দেখা যায় নাই। তৃণমূল কংগ্রেস অকালবিবাহ রোধ করিবার প্রকল্পে জনগণের বিপুল অর্থ খরচ করিতেছে, তাহার ‘সাফল্য’-এ মুখ্যমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানাইতে আর এক দফা খরচ হইতেছে রাজকোষ হইতে। কিন্তু সেই দলেরই পঞ্চায়েত সদস্য নাবালিকা কন্যার বিবাহে ‘ছাড়’ দাবি করিতেছে। সরকারি প্রকল্পের সহিত দলীয় রাজনীতির সংযোগ নাই। তাই গ্রামে গ্রামে, ব্লকে ব্লকে নাবালিকা বিবাহ অবাধে ঘটিয়া চলিয়াছে। রাজনৈতিক বাহুবলীরা তাহার ভোজে নিমন্ত্রিত হইয়া উদরপূর্তি করিতেছেন।

এই দ্বিচারিতাকে কিছু ভণ্ড নেতার মূর্খামি ভাবিলে ভুল হইবে। এই দ্বিমুখিতাই আজ রাষ্ট্রের স্বরূপ। সরকারি কর্মসূচি অনেক উদার মতবাদের ধ্বজা উড়াইয়া, প্রান্তবাসীদের সক্ষমতার জয়গান গাহিয়া, বহু কোটি টাকার প্রকল্প রূপায়ণ করিতেছে। আর রাজনৈতিক দলগুলি প্রতিটি কাজে, প্রতি পদক্ষেপে চরম রক্ষণশীল কাজ করিয়া চলিয়াছে। এই ব্যবস্থায় প্রগতির নাটকের অন্তরালে বাস্তব স্থিতাবস্থা বজায় থাকিতেছে। নাবালিকা বিবাহ আজ রুখিয়াছে। কাল আবার হইবে না, কে বলিতে পারে? আগাম ‘ছাড়’ নিশ্চিত করিবার উপায় কম নাই।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন