সম্পাদকীয় ২

তাড়নার শিক্ষা

নির্মম সত্য ইহাই যে, ওই দৃশ্যটি দেখিয়া এখন সকলেই যারপরনাই ছি-ছি করিতেছেন বটে, কিন্তু এমন ঘটনার ইতরবিশেষ খুঁজিয়া পাওয়া সম্ভব ঘরে ঘরে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০১৭ ০০:০০
Share:

শিক্ষাদানের জন্য শিশুকে প্রহার করিবার প্রথাটি কোথায় কবে জন্মাইল, তাহা একটি সমাজবিজ্ঞান-গবেষণার বিষয়বস্তু হইতে পারে। ‘তাড়য়েৎ পঞ্চবর্ষাণি...’ অথবা ‘স্পেয়ার দ্য রড অ্যান্ড স্পয়েল দ্য চাইল্ড’ গোছের প্রবচনগুলি জানাইয়া দেয় যে, শিশুকে বিদ্যা বা সদাচার শিখাইবার প্রয়োজনে তাড়নার প্রথা নূতন নহে। কালক্রমে দুনিয়ার বহু দেশেই সেই রীতি বন্ধ হইয়াছে, নীতি স্থির হইয়াছে যে, শিশুকে কোনও কারণেই প্রহার চলিবে না। শিশুর অধিকারের ধারণাটি অনেক পশ্চিমি দেশে এতটাই গুরুত্ব অর্জন করিয়াছে যে শিশুকে যে কোনও প্রকারে শারীরিক বা মানসিক নিপীড়নের অভিযোগে কঠোর শাস্তি হইতে পারে। এমন নীতি বা রীতিকে অনেকেই আবার বাড়াবাড়ি বলিয়া গণ্য করেন। কিন্তু একটি নিতান্ত শিশু-পড়ুয়াকে এক দুই তিন শিখাইবার জন্য তাহার উপর ভয়াবহ দাপটে সন্ত্রস্ত অসহায় শিশুটির যে ক্রন্দনধ্বস্ত মুখচ্ছবি গোটা দেশে ঝড়ের গতিতে ছড়াইয়া পড়িয়াছে, তাহাতে নিহিত হিংসাত্মক উদ্‌ভ্রান্তিটি কোনও যুক্তিতেই সভ্য সমাজে মানিয়া লওয়া চলে না।

Advertisement

নির্মম সত্য ইহাই যে, ওই দৃশ্যটি দেখিয়া এখন সকলেই যারপরনাই ছি-ছি করিতেছেন বটে, কিন্তু এমন ঘটনার ইতরবিশেষ খুঁজিয়া পাওয়া সম্ভব ঘরে ঘরে। শিশুপাঠ নামক বিষয়টির মধ্যে জবরদস্তি কেবল কোনও ব্যক্তিবিশেষের সমস্যা নয়, গোটা সমাজের সমস্যা। পিতামাতা বা অভিভাবক যে তাঁহাদের দায়িত্বে থাকা কচি মানুষটির মনের যত্ন লইবার কথা এই ভাবে ভুলিয়া যাইতে পারিতেছেন, তাহার একটি বড় কারণ তাঁহাদের আত্যন্তিক উদ্বেগ ও আশঙ্কা— তাঁহাদের শিশুটি এই বোধহয় ভাল বিদ্যালয়ে সুযোগ পাইল না, এই বোধহয় সাফল্য ও সাচ্ছল্য তাঁহাদের মুষ্টি গলিয়া বাহির হইয়া গেল। শিশুসন্তান তাঁহাদের কাছে একটি স্বাভাবিক মানবিক নহে, সে তাঁহাদের সাফল্যের আশা, সাচ্ছল্যের স্বপ্ন। সেই আশা বা স্বপ্ন যে কেবল হাতে গোনা কতগুলি ‘ভাল’ বিদ্যালয় ছাড়া হয় না, ইহাও তাঁহাদের সমাজ তাঁহাদের শিখাইয়াছে। প্রসঙ্গত, ইতিহাসবিদ তথা শিক্ষাবিদ রমিলা থাপর সম্প্রতি এই শহরের এক সভায় বক্তৃতাসূত্রে বলিয়াছেন, শিক্ষার একমাত্র অর্থ যেখানে ‘সাকসেস’ অর্থাৎ সাফল্য, সেখানে যথার্থ শিক্ষা প্রবেশ করিবে কী ভাবে?

শিশুকে মারিয়া ধরিয়া অক্ষরপরিচয় করান যাঁহারা, তাঁহারা শিশুর মধ্যে জ্ঞানের আলোক ছড়াইয়া দিবার কথা ভাবেন না, তাঁহারা চাহেন কেবল সাফল্যের মই বাহিয়া উঠিবার দক্ষতাটুকু ধরাইয়া দিতে। চার পাশের উদ্‌ভ্রান্ত সামাজিক প্রতিযোগিতার চাপ না সরিলে ভালবাসা বস্তুটি ক্রমেই আকাশের চাঁদের মতো দূরগত মরীচিকা থাকিয়া যাইবার সম্ভাবনা। শিশু যে বিশ্বপৃথিবীর সহিত তাহার প্রথম পরিচয়ের অংশ হিসাবেই অক্ষরপরিচয়ের পাঠ লয়, পাঠদানের সময় উল্টা দিকের বয়ঃপ্রাপ্ত মানুষটির যে অনেকখানি ধৈর্য, সংযম, দূরদৃষ্টি, অন্তর্দৃষ্টি লাগে, সমাজের বিরাটবিস্তৃত অভিভাবক সমাজকে এই দার্শনিক কথাটি বুঝানো যাইবে কী করিয়া, সমস্যার সমাধান খোঁজ করিতে হইবে এই ভাবনা হইতে। ওই ভিডিয়োতে যিনি শিশুকে পড়াইবার নামে উন্মত্ত আচরণ করিতেছিলেন, তিনি এই বিপুল সামাজিক বিকারের একটি চরম বিন্দুমাত্র।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন