স্বাধীন দেশের আশি লক্ষ দাস

ঘন নীল ফুলশার্টের হাতা নেমেছে ডান হাতের আস্তিন অবধি। তার নীচে কিছু নেই। ওড়িশার কালাহান্ডির দয়ালু নিয়াল ভূমিহীন পরিবারের ছেলে, ছোবড়ার দড়ি তৈরি করে পেট চলে।

Advertisement

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০৫
Share:

শিশু শ্রমিক

গোল টেবিলের কোণ হয় না, তবু যেন কোণ খুঁজছিল ছেলেটি। সামনে পাঁচ-ছ’জন সাংবাদিক। ফিল্মস্টার থেকে সন্ত্রাসবাদীর চাঁই, কাকে না ইন্টারভিউ করেছেন তাঁরা। কিন্তু এখন প্রশ্ন সরছে না কারও মুখ দিয়ে। শেষে এক জন বললেন, ‘এখনও কি হাতে ব্যথা?’ বছর একুশের ছেলেটি মাথা নাড়ল, না। তবে কখনও বরফের মতো ঠান্ডা মনে হয় হাতটা, কখনও অবশ লাগে।

Advertisement

ঘন নীল ফুলশার্টের হাতা নেমেছে ডান হাতের আস্তিন অবধি। তার নীচে কিছু নেই। ওড়িশার কালাহান্ডির দয়ালু নিয়াল ভূমিহীন পরিবারের ছেলে, ছোবড়ার দড়ি তৈরি করে পেট চলে। গাঁয়েরই ঠিকাদার বলেছিল, দিনে একশো টাকার খেতমজুরি দেবে। গ্রামের ন’জনের সঙ্গে দয়ালুও ট্রেনে উঠেছিল। যেতে যেতে বুঝল, চালান হচ্ছে অন্ধ্রের ইটভাটায়। বন্দি রেখে বেগার খাটানো হবে। স্টেশন থেকেই চম্পট দিল সবাই। ধরা পড়ে যায় দু’জন। দয়ালু আর নীলাম্বর।

শ্রমিক জোগানোর জন্য দু’লক্ষ টাকা নিয়ে পালিয়েছে ঠিকাদার। ভাটা মালিক বলল, টাকা না দিলে ছাড় নেই। উদয়াস্ত খাটানো, মারধর, শেষে খুন করার ছক। হাতে-পায়ে ধরতে লাগল দয়ালু আর নীলাম্বর। মাতাল মালিক শর্ত দিল, খুন হতে না চাইলে কেটে নেওয়া হবে ডান হাত। দয়ালুর সামনেই নীলাম্বরের হাত কাটা হল, তার পর ওর পালা। কব্জি থেকে কাটা হাত নিয়ে, রক্তে-ভাসা শরীরে কী ভাবে তারা ফিরল, উহ্য থাক। তখন দয়ালুর বয়স সতেরো।

Advertisement

এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার চেষ্টায় ধরা গিয়েছে দোষীদের, জেল খাটছে ন’জন। কিন্তু তাতে বিস্ময় ঘোচে না। আজও এমন হয়? হয় বইকি। এই তো ২০১৫ সালে মেদিনীপুরের পিংলায় বাজি কারখানার বিস্ফোরণে আট শিশু-সহ দশ জনের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। মুর্শিদাবাদের সুতিতে বাড়ি। ঠিকাদার বলেছিল, রাজমিস্ত্রির হেল্পারের কাজে নিয়ে যাচ্ছে। গত বছর আত্মহত্যা করল দর্শিনী বালসুব্রহ্মণি। গ্রাম থেকে তিরুপুরের কাপড়-কলে আনে ঠিকাদার। হস্টেলে কড়া পাহারা, মোবাইলও নিষিদ্ধ। তিন বছরের চুক্তি, মাইনের অনেকটা জমা থাকে, আগে কাজ ছাড়লে কাটা যাবে টাকা। এক দিন পর পর দুটো আট ঘণ্টার শিফট করে হস্টেলে ফিরে দর্শিনী শোনে, পর দিন ফের ষোলো ঘণ্টার ডবল ডিউটি। সে রাতে গলায় দড়ি দেয় সে। আর এগারো দিন বাঁচলে দর্শিনীর বয়স হত চোদ্দো।

তামিলনাড়ুতে ৭৪৩টি কাপড় কল রয়েছে, তার মধ্যে ৩৫১টি এই প্রথায় কাজ করায় মেয়েদের, বলছে একটি আন্তর্জাতিক রিপোর্ট। একে ‘আধুনিক দাসপ্রথা’র দৃষ্টান্ত বলছে ওই সংস্থা। তাদের বিশ্ব দাসত্ব সূচকে (‘গ্লোবাল স্লেভারি ইনডেক্স’) ভারতের স্থান ১৮৭ দেশের মধ্যে ৫৩। তাদের হিসেব, বিশ্বে অন্তত চার কোটি লোক দাস-শ্রমিক, তাদের আশি লক্ষ ভারতে। সরকার অবশ্য দাসত্বের এই সংজ্ঞা মানতে রাজি নয়। সত্যিই তো, দাসপ্রথা বললেই উপনিবেশে কৃষ্ণাঙ্গদের কথা মনে পড়ে। মনে হয়, ‘স্বাধীন ভারতে এমন হয় নাকি? যত্ত বাড়াবাড়ি।’

জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড বুরোর রিপোর্ট বলছে, দেহব্যবসার জন্য যত পাচার হয়, তার দ্বিগুণ হয় শ্রমের জন্য। কখনও মাফিয়া-মালিকের খুনের হুমকি, কখনও আগাম টাকার ঋণের জাল তাদের বন্দি করে। আর বিপন্নতার পরিমাপ? একটি সমীক্ষা বলছে, ২০১৪ থেকে আজ অবধি ৪৫০ ভারতীয় শ্রমিক মারা গিয়েছে দুবাইতে।

দয়ালু-দর্শিনী ‘দাস’ কি না, বিতর্ক চলতে পারে। কিন্তু ইটভাটা, কার্পেট কারখানা, আখের খেত, পাথরখাদানের মজুরেরা কি চাইলেই যেখানে খুশি যেতে পারে? পেতে পারে হকের টাকা? অত্যাচার থেকে বাঁচতে পারে? নিত্য যৌন নির্যাতন সইতে হয় শিশু ও মেয়েদের, যারা দাসশ্রমিকদের সত্তর শতাংশ। তাদের মধ্যে গৃহপরিচারিকাও আছে। ২০১৬ সালে তেইশ হাজার পাচার-করা মানুষ উদ্ধার হয়, তাদের চোদ্দো হাজারের বয়স ছিল আঠারো বছরের কম, বলছে সরকারি তথ্য।

‘দাসত্ব’ না-ই বলা হোক, ঠিকাদার-নির্ভর মজুরদের বিপন্নতা খেয়াল করা চাই, কারণ তা বাড়ছে। কৃষিতে বিপর্যয়ের জন্য গ্রামে কমছে কাজ। ২০১১ সালের পর থেকে মজুরি বাড়েনি বললেই চলে। ২০১৪-২০১৬, এই দু’বছরে দিনমজুরদের আত্মহত্যার সংখ্যা প্রায় দশ হাজার (ষাট শতাংশ) বেড়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ ঘর ছাড়ছে জীবিকার খোঁজে, ঠিকাদারের হাত ধরে। তাদের একটা বড় অংশের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। খুন, আত্মহত্যা, গণধর্ষণ নিয়ে তবু শোরগোল হয়। কিন্তু সব মৃত্যুই তো ফৌজদারি ধারায় পড়ে না। কর্নাটকের কাপড় কলে কর্মরত তরুণীদের অসুস্থতা এবং মৃত্যুর হার এতই বেশি, যে শ্রম কমিশনার কারণ খুঁজতে বলেছে আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়কে। গবেষকরা দেখছেন, কারখানার তীব্র গরমে বসাই দায়, কর্মীরা দশ ঘণ্টা কাজ করবে কী?

বেঁচে থাকার জন্য কাজ করে মজুর, কিন্তু কাজই জীবনীশক্তি কেড়ে নিচ্ছে। এমনকি জীবনও। আর আমাদের গায়ের গেঞ্জি থেকে বাড়ির ইট, সব পণ্যে লেগে থাকছে সেই পীড়নের দাগ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন