পড়ুয়াদের পিঠে ব্যাগের ওজন কেমন হবে তাই নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার কিছু পরিসংখ্যান দিয়েছে। সাধারণ ভাবে আমাদের দেশে রাজনীতির গতিপ্রকৃতি যে দিকে, তাতে মানুষের শিরদাঁড়া খাড়া না থাকাটাই মঙ্গল। শিশুবয়স থেকে পিঠে ভারী ব্যাগ চাপালে মেরুদণ্ড বাঁকিয়ে দেওয়া সহজ। তবে সরকারের তো বকধার্মিকতার দায়ও আছে। তাই ব্যাগের ওজন নিয়ে কিছুটা হইচই মাঝে মাঝেই হয়ে থাকে।
মানবসম্পদ উন্নয়ন দফতরের উদ্যোগে পিঠের ব্যাগ নিয়ে এই আলোচনা আদতে মূল সমস্যাটাকে এড়িয়ে যাওয়ার। আসল মুশকিল আমাদের দেশের বিশালাকায় মধ্যবিত্ত সমাজে শিক্ষাক্ষেত্রে যে তীব্র প্রতিযোগিতা সেইখানে। উদাহরণ দেওয়ার জন্যে শুরুতেই ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনলজি-র প্রবেশিকা পরীক্ষার কথা বলতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে এই পরীক্ষায় বছরে দশ লাখের ওপর ছাত্রছাত্রী অংশগ্রহণ করে। এরা প্রত্যেকেই রীতিমতো প্রস্তুতি নিয়ে আসে এই পরীক্ষায় সফল হওয়ার জন্যে। কিন্তু সব মিলিয়ে আইআইটিতে আসনসংখ্যা দশ হাজারের আশেপাশে। তার মধ্যে পুরনো এবং নামজাদা আইআইটিগুলোতে ভাল কোনও বিষয়ে পড়তে গেলে সফল পরীক্ষার্থীদের তালিকায় প্রথম হাজার দুয়েকের মধ্যে থাকতে হয়। শুধু আইআইটি নয়, প্রযুক্তিবিদ্যা নিয়ে পড়তে গেলে এনআইটিগুলোতে, কিংবা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রতিযোগিতা অস্বাভাবিক। ডাক্তারির ক্ষেত্রেও প্রতিযোগিতা একই রকম শক্ত। অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্স (এআইআইএমএস)-গুলোতে সুযোগ পেতে লক্ষ লক্ষ পরীক্ষার্থীর মধ্যে একদম প্রথম কয়েকশোর মধ্যে থাকতে হয়। এ তো গেল উচ্চ মাধ্যমিকের পরে পরীক্ষার কথা। স্নাতক স্তর পার করার পর আইএএস গোছের পরীক্ষায় সফল হওয়া প্রায় অলিম্পিকে সোনা পাওয়ার মতো শক্ত। সোজা কথায় প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতা অমানুষিক।
যাঁরা এই প্রবেশিকা পরীক্ষাগুলোতে প্রশ্নপত্র তৈরি করছেন তাঁদের ক্ষেত্রেও এ এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। ধরুন শূন্য থেকে একশোর মধ্যে নম্বর দিয়ে পড়ুয়াদের বিচার করা হবে। সে ক্ষেত্রে পরীক্ষার্থী যদি থাকে দশ লক্ষের বেশি, তা হলে এক একটি নম্বরে হাজার হাজার নাম থাকবে। তাদের মধ্যে কে আগে কে পরে সেই তালিকা প্রস্তুত করা ভীষণ শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। কোথাও বলা হয় দু’জনের নম্বর মিলে গেলে আগে অঙ্কে কে কেমন করেছে দেখা হবে, কোথাও বলা হয় কার বয়স কম সেটাই বিবেচ্য। সব মিলিয়ে এ এক অসম্ভব শক্ত বিচার। তার ওপর যাঁরা এই পরীক্ষাগুলোর দায়িত্ব নিয়েছেন তাঁরা অনেকেই ততটা দক্ষ নাও হতে পারেন। একটা সহজ উদাহরণ দিলেই বিষয়টা পরিষ্কার হবে। কোনও কঠিন প্রবেশিকা পরীক্ষায় যাঁরা প্রশ্ন করছেন তাঁদের বেশির ভাগই এই পরীক্ষাগুলোতে সফল হননি। সে ক্ষেত্রে তাঁরা কতটা ভাল বিচার করতে পারবেন সে নিয়ে সন্দেহ থাকবেই। এর সঙ্গে আছে কোচিং ক্লাসের চক্র। দেশের নামীদামি পরীক্ষাগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজার হাজার কোটি টাকার বেসরকারি ব্যবসা। আর এই সবের অত্যাচারে নাভিশ্বাস পড়ুয়াদের। ছোটবেলা থেকে যৌবন পর্যন্ত কেটে যাচ্ছে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে।
পিঠের বস্তা নয়, দীর্ঘ ছাত্রজীবনে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর মাথার বোঝা। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জুজুতে প্রতিটি শ্রেণিতে সিলেবাস ছাড়াও পড়তে হচ্ছে উঁচু ক্লাসের গাদা গাদা বই। এর সঙ্গে পঠনপাঠনের পরিধিও বেড়েছে অনেকটা। আশির দশকে ভারতবর্ষের যে কোনও রাজ্যে দশ বা বারো ক্লাস স্তরে বিজ্ঞানের সিলেবাস যদি দেখেন, আর তার সঙ্গে তুলনা করেন আজকের পড়াশোনার, তা হলে খুঁজে পাবেন যে কত বেশি বিষয় ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে ছোট্ট মাথার অন্দরে।
এর একটা বড় দায় বেসরকারি ক্ষেত্রের। ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকেই বছরে তাঁদের ছেলেমেয়ের পড়াশোনার জন্যে পাঁচ-দশ লক্ষ টাকা খরচ করতে রাজি। মুশকিল হচ্ছে দুয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া প্রযুক্তিবিদ্যা কিংবা চিকিৎসাশাস্ত্রে বাকিদের মান অত্যন্ত খারাপ। বিজ্ঞান বা কলাবিভাগেও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উচ্চ মেধার পড়ুয়ারা ভর্তি হতে চায় না। এ সব জায়গায় পড়াশোনা করে চাকরি বা ভবিষ্যতে গবেষণার ক্ষেত্রে সুবিধের চেয়ে অসুবিধেই বেশি। বেসরকারি সংস্থাগুলো মূলত মুনাফালোভী এবং ছাত্র ভর্তি থেকে পড়াশোনা শেষ করে ডিগ্রি দেওয়া পর্যন্ত সেখানে বিভিন্ন বেআইনি বিষয়ের আশ্রয় নেওয়া হয়। সেই সব জায়গায় অধ্যাপকদের মান তথৈবচ। তাই বেশির ভাগ বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজই আজ ধুঁকছে, পঞ্চাশ শতাংশ আসনও ভর্তি হচ্ছে না। আপাতত আমাদের দেশের যা অবস্থা, তাতে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসন সৃষ্টি করে প্রতিযোগিতার তীব্রতা কমানো অসম্ভব। পরিষেবাগত ত্রুটি থাকলেও সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই সব থেকে ভাল ছাত্রছাত্রীরা যেতে চাইছে। আবার আমাদের দেশে অর্থনীতি যে দিকে বাঁক নিচ্ছে তাতে গাদা গাদা নতুন সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চটজলদি বানানো সম্ভব নয়। বরং প্রযুক্তি এবং চিকিৎসাশাস্ত্র ছাড়া বাকি সরকার পরিচালিত কলেজগুলোর দিকে বেশি করে নজর দিতে পারে মানব সম্পদ উন্নয়ন দফতর।
একটা উদাহরণ দিই। অঙ্ক, রসায়ন বা পদার্থবিদ্যা পড়তে এ রাজ্যের সেরা ছাত্রছাত্রী কিন্তু সেই আইআইটি, আইআইএসইআর, কিংবা যাদবপুরে ছোটে। এই বিষয়গুলি কলকাতা এবং তার আশেপাশে অন্তত একশোটি সরকার পরিচালিত কলেজে পড়ানো হয়। সেখানকার অধ্যাপক-অধ্যাপিকারা অবশ্যই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির থেকে অনেক বেশি উঁচু মানের। এই কলেজগুলিকে ভাল জায়গায় পৌঁছে দিলে তবেই উচ্চ মেধার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা কিছুটা সরল হবে। তা না হলে মানব সম্পদ উন্নয়ন দফতরের ব্যাগের ওজন সংক্রান্ত অগভীর ঘোষণায় এ দেশের মধ্যবিত্ত শিশু-কিশোরদের একটুও উপকার হবে না।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের শিক্ষক