সম্পাদকীয় ২

ঘৃণার প্রতাপ

সমাজের উচ্চস্তরে ভেদাভেদ প্রথা স্পষ্ট প্রতীয়মান হইলে নিম্নস্তরে তাহা প্রকটতর হইবেই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:৩১
Share:

দলিত। শব্দখানি কর্ণগোচর, কিংবা মর্মগোচর হওয়ামাত্রই তেলেবেগুনে জ্বলিয়া উঠেন কিয়দংশের ভারতীয় নাগরিক। এই ক্রোধ বড় অকৃত্রিম, খাঁটি। উহারা কেন বড় প্রতিষ্ঠানে পড়িবার সুযোগ পাইবে, কেন চাকুরিক্ষেত্রে অধিক সুবিধা ভোগ করিবে, উহাদের লইয়া এত আলোচনা কেন? সার কথাটি— বামন হইয়া কেন চাঁদে হাত দিবে? ইত্যাকার সকল প্রশ্নই ক্রোধের দ্বারা চালিত, ঘৃণার দ্বারা উৎসারিত। ঘৃণা স্বভাবতই বিকৃত, তবে তাহা হিংস্র হইয়া উঠিলে ভয়ানক কদর্যতা প্রকাশ পায়। উদাহরণ, ভিল সম্প্রদায়ের সন্তান হইবার অপরাধে নির্যাতিত হইয়াছিলেন মহারাষ্ট্রের ডাক্তারির ছাত্রী পায়েল তদভি। উদাহরণ, দলিত পরিচিতির কারণে অন্যায্য শাস্তিলাভ করিয়াছিলেন হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের দলিত পড়ুয়া রোহিত ভেমুলা। পায়েল এবং রোহিত আত্মহননের পথ বাছিয়াছিলেন। যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই পন্থারও প্রয়োজন পড়ে না। ‘উচ্চাসন’-এ বসিয়া থাকা ব্যক্তিরাই সমাজের সম্মান রক্ষার্থে শেষ করিয়া দেয় ‘নিচু’কে— ‘অনার কিলিং’। সম্মান রক্ষার্থে হত্যা। উত্তরপ্রদেশের হরদোই-এর অভিশঙ্ক পালও নিহত হইলেন। অসম্মানে শেষ হইয়াছিলেন বহু পূর্বেই, কেবল তাঁহাকে জীবন্ত পুড়াইয়া সমাজ প্রমাণ করিল, এত কাল তিনি মরেন নাই। অসুস্থ মা-কে দেখিতে হাসপাতালে যাইবার পথে অভিশঙ্ককে খাটিয়ায় বাঁধিয়া গায়ে আগুন লাগাইয়া দেয় তাঁহার প্রণয়িনী শিবানী গুপ্তর পরিবারের সদস্যেরা। পরিবারের সম্মানরক্ষার্থেই এই কাজ, জানাইয়াছেন পাঁচ অভিযুক্ত।

Advertisement

সমাজের উচ্চস্তরে ভেদাভেদ প্রথা স্পষ্ট প্রতীয়মান হইলে নিম্নস্তরে তাহা প্রকটতর হইবেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ঘটনাবলিতে ফিরিলে দেখা যাইবে, গত বৎসর আইআইটি কানপুরে অভিযোগ উঠিয়াছিল, দলিত শিক্ষক সুব্রহ্মণ্যম সান্দেরলা-কে হেনস্থা করিয়াছেন অপর চার শিক্ষক। তবে পায়েল এবং রোহিতের সহিত এই ঘটনাকে জুড়িলে আরও একটি ধারা স্পষ্ট হইবে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ন্যায় যে সকল পরিসরকে সমাজের শ্রেষ্ঠাংশ বলিয়া ভাবা হইত, উহাতেও জাতপাতের কদর্যতা আসলে একই রূপে বর্তমান। বস্তুত, উচ্চশিক্ষার গজদন্তমিনারে নিম্নবর্গের মানুষের ‘অনুপ্রবেশ’ সেই ঘৃণাকে আরও উস্কাইয়া দেয়। এই ঘৃণা পূর্বেও ছিল না এমন নহে, তবে ‘নূতন ভারত’ যত উদিত হইতেছে, তত উদ্দেশ্য ও বিধেয়র পার্থক্য ঘুচিতেছে। অতএব কেবল অন্যায় কাজ করিয়া ক্ষান্ত দিলে চলে না, বুক বাজাইয়া তাহা বলিয়া বেড়াইতেও হয়।

আশার কথা, আইআইটি কানপুরের তদন্ত প্রক্রিয়ায় চার শিক্ষকই দোষী সাব্যস্ত হইয়াছেন, এবং প্রত্যেকেরই শাস্তির প্রক্রিয়া শুরু হইয়াছে। উহাদের ভিতর এক জন, রাজীব শেখর, আইআইটি (ধানবাদ)-এর অধিকর্তা নিযুক্ত হইয়াছিলেন। তাঁহার বিরুদ্ধে এত কাল ব্যবস্থা লওয়া সম্ভব হয় নাই, কেননা তাঁহার নিয়োগে সম্মতি দিয়াছিলেন রাষ্ট্রপতি। শেষাবধি, পূর্বের বিচার অনুসারে শেখরের পদাবনতির সিদ্ধান্ত গৃহীত হইয়াছে। স্মরণে রাখা আবশ্যক, এই ঘটনা ব্যতিক্রমমাত্র। ভারতীয় সমাজে ছড়াইয়া আছেন পায়েল রোহিত অভিশঙ্কের ন্যায় দুর্ভাগারা, যৎসামান্য আলো দেখাইলেও সান্দেরলারা কিন্তু একাই রহিয়া গিয়াছেন। অবশ্য সুস্থ সমাজ গড়িতে হইলে কায়মনোবাক্যে ব্যতিক্রমের দীর্ঘায়ু কামনা করিতেই হইবে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন