২০২০-র ভারতে চোরাশিকারিরাই পরিচিত ‘চাণক্য’ নামে
Crime

এ সবই ‘মানুষের কল্যাণে’?

লিঙ্কনের আমেরিকা থেকে এ বার এক ঝটকায় নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের ভারতে ফেরেন বিজেপির তরুণ তুর্কি।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০২০ ০২:০১
Share:

ছক: জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার দল বদলের পরে কংগ্রেস সমর্থকদের বিক্ষোভ। ভোপাল, ১১ মার্চ। পিটিআই

লিঙ্কন সিনেমার সেই বিখ্যাত উক্তিটা মনে পড়ছে? কর্নাটক-মহারাষ্ট্রের পর এ বার মধ্যপ্রদেশে অন্য দলের বিধায়ক ভাঙিয়ে বিজেপির সরকার গঠনের চেষ্টা নিয়ে প্রশ্ন করতেই পাল্টা প্রশ্ন উড়ে এল। কোন উক্তি? বিজেপির তরুণ শিক্ষিত নেতা মুচকি হাসেন। তার পর বলেন, “ঊনবিংশ শতাব্দীর বৃহত্তম পদক্ষেপ ছিল আমেরিকায় দাসপ্রথা বিলোপ। সে সময় আমেরিকার পবিত্রতম মানুষ বলে পরিচিত প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন সেই আইন পাশ করাতেও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছিলেন”।

Advertisement

কথাটা মিথ্যে নয়। আব্রাহাম লিঙ্কন যখন আমেরিকায় দাসপ্রথা বিলোপ করে গোটা দুনিয়ার ইতিহাসে পাকাপাকি ভাবে জায়গা করে নিচ্ছেন, তখন আমেরিকার সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাশ করিয়ে দাসপ্রথা বিলোপ করতে তাঁকে ভোট কিনতে হয়েছিল। নানা সরকারি পদের লোভ দেখিয়ে তবে সংবিধান সংশোধনী পাশ করানোর মতো ভোট জোগাড় করতে পেরেছিলেন লিঙ্কন।

লিঙ্কনের আমেরিকা থেকে এ বার এক ঝটকায় নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের ভারতে ফেরেন বিজেপির তরুণ তুর্কি। কর্নাটক-মহারাষ্ট্র-মধ্যপ্রদেশের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “আসলে মানুষের কল্যাণে আমাদের রাজনীতিতে এমন অনেক কিছুই করতে হয়, যা করা উচিত নয়।”

Advertisement

মানুষের কল্যাণে? মানুষের ভোটে জিতে এক দলের বিধায়কেরা আর এক দলের কাছে আশ্রয় নিচ্ছেন। নিজের রাজ্য ছেড়ে অন্য রাজ্যের রিসর্টে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছেন। না হলে যদি তাঁর মুখে লাগাম পরিয়ে আবার পুরনো আস্তাবলে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়! এক বার বিকিয়ে যাওয়া বিধায়ক তা হলে আর এক বার নিজেকে বেচতে বাধ্য হবেন। এ সবই মানুষের কল্যাণে?

এই ঘোড়া কেনাবেচার রাজনীতি, বা দুর্নীতি, যাকে ‘চাণক্য-নীতি’ বলে তকমা দেওয়া হচ্ছে, তা এখন শত পুষ্পে বিকশিত। বাংলায় লোকসভা ভোটের প্রচারে গিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রকাশ্যে বলেছিলেন, তৃণমূলের ৪০ জন নেতা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। ভোটের ফল বার হলেই তাঁরা তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেবেন। প্রশ্ন উঠেছিল, দেশের ইতিহাসে আর কোনও প্রধানমন্ত্রী কি এই ভাবে খোলাখুলি ঘোড়া কেনাবেচার কথা বলেছেন! স্বাভাবিক নিয়মেই প্রধানমন্ত্রীর ডান হাত অমিত শাহ কর্নাটকে বিজেপিকে ভোটে জেতাতে না পারলেও সরকার গড়ে ফেলে চাণক্যের শিরোপা পান। মহারাষ্ট্রে মধ্যরাতে রাষ্ট্রপতি শাসন তুলে দিয়ে রাতারাতি বিজেপির দেবেন্দ্র ফডণবীস মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে ফেললে, শাহের মাথায় চাণক্যের শিরোপা এঁটে বসে। দিল্লির বিধানসভা ভোটে হারের পরে সেই চাণক্যের মুকুট নড়বড়ে হয়ে গেলে বিজেপি ফের মধ্যপ্রদেশে কমল নাথের সরকার ফেলতে মাঠে নামে। ক্ষমতা এবং চাণক্য শিরোপার পুনরুদ্ধারে— কোথাও অস্ত্র টাকার ঝুলি, কোথাও মন্ত্রিত্বের লোভ, কোথাও অবার সিবিআই-ইডি তদন্তের জুজুই হাতিয়ার।

ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’। গত ছ’বছরে মোদী বা তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্য দুর্নীতির অভিযোগ কোনও বিরোধীই তুলতে পারেননি। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, রাজ্যে রাজ্যে অন্য দলের বিধায়কদের টাকা বা ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে ভাঙিয়ে এনে যে সরকার গড়া হচ্ছে, সেই সরকারের পক্ষে কি দুর্নীতিমুক্ত থাকার কথা বলা সাজে? বিজেপির যে মুখ্যমন্ত্রী বিপুল টাকা খরচ করে গদিতে বসলেন, তাঁর পক্ষে কি দুর্নীতিমুক্ত সরকার চালানো সম্ভব? সরকার গড়তে খরচ করার অর্থের অন্তত দ্বিগুণ টাকা তিনি পকেটে পোরার চেষ্টা করবেনই। আবার বিজেপির ভাঙনের খেলা রুখতে যে সব কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীদের বিপুল টাকা ছড়াতে হচ্ছে, বিধায়কদের রিসর্টে নিয়ে গিয়ে রাখতে হচ্ছে, তাঁকেও তো সেই খরচ তুলে নিতে হবে! তা সে সরকারি বরাত পাইয়ে দিয়েই হোক বা অন্য কোনও উপায়ে। ‘রিসর্ট রাজনীতি’-র পালে হাওয়া জুগিয়ে বিজেপি নেতৃত্ব কি নিজেরাই দুর্নীতির মঞ্চ তৈরি করে দিচ্ছেন না?

এক সময় রাজা-রাজড়ারা আরবে ঘোড়া কিনতে লোক পাঠাতেন। ১০০টা ঘোড়া কেনার মোহর দিয়ে পাঠানো হলে তারা ৮০টা ঘোড়া নিয়ে ফিরে এসে জবাব দিত, বাকি বিশটি ঘোড়া পথেই অক্কা পেয়েছে। মিথ্যেকে সত্য প্রমাণ করতে তারা ঘোড়ার লেজ কিনে নিয়ে আসত। ঘোড়া কেনাবেচার কুখ্যাতি সেই তখন থেকেই।

এমন নয় যে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার আগে এ দেশে ঘোড়া কেনাবেচার রাজনীতি ছিল না। ১৯৬৭-তে যখন হরিয়ানায় প্রথম অ-কংগ্রেসি সরকার তৈরি হয়, তখন রাজ্যের বিধায়ক গয়া লাল ১৫ দিনে তিন বার দলবদল করেছিলেন। তার মধ্যে এক বার ন’ঘণ্টার মধ্যে দলবদল করেছিলেন। শেষে যখন তিনি ফের কংগ্রেসে যোগ দেন, তখন তাঁকে সাংবাদিক সম্মেলনে হাজির করে কংগ্রেস নেতা রাও বীরেন্দ্র সিংহ বলেছিলেন, “গয়া রাম এ বার আয়া রাম”। আশির দশকে গোয়া, হরিয়ানা, অন্ধ্রে এই ‘আয়া রাম, গয়া রাম’-এর রাজনীতি বহাল ছিল। ১৯৯৩-এ কেন্দ্রে পি ভি নরসিংহ রাও সরকারের বিরুদ্ধে আস্থাভোটে জিততে শিবু সোরেনের ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চাকে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। তার পাঁচ বছর পরে উত্তরপ্রদেশে কল্যাণ সিংহের বিজেপি সরকার ফেলে দিয়ে লোকতান্ত্রিক কংগ্রেসের জগদম্বিকা পালের ৪৮ ঘণ্টার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসার ইতিহাসও পুরনো নয়।

সেই পথে হেঁটেই মণিপুর, অরুণাচল থেকে গোয়া, কর্নাটক থেকে মহারাষ্ট্র, এ বার মধ্যপ্রদেশে নতুন মাইলফলক স্থাপন করতে করতে এগোচ্ছেন মোদী-শাহ জুটি। ১৯৮৫-তে রাজীব গাঁধী সংবিধান সংশোধন করে দলবদল ঠেকানোর ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। যাতে এক দলের টিকিটে জিতে বিধায়ক হওয়ার পর আর এক দলে যোগ দিলে বিধায়ক পদই বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু মধ্যপ্রদেশে সেই দলবদল ঠেকানোর আইনকেও বুড়ো আঙুল দেখিয়েই বিধায়কদের চোরাশিকার চলছে। কংগ্রেস থেকে বিজেপি শিবিরে যোগ দেওয়া বিধায়কেরা সরাসরি ইস্তফা দিয়ে দিচ্ছেন। ফলে বিধানসভায় সরকার সংখ্যালঘু হয়ে পড়ছে।

প্রধানমন্ত্রী মোদী ‘এক রাষ্ট্র, এক ভোট’-এর মন্ত্রে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচন একসঙ্গে করার প্রস্তাব হাজির করেছেন। বিরোধীদের আশঙ্কা, তিনি মোদী-ম্যাজিকে গোটা ভূভারতেই কেন্দ্রে ও রাজ্যে বিজেপি শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন। কারণ লোকসভায় এখনও মোদী-ম্যাজিক অটুট হলেও বিধানসভা ভোটে তা আর কাজ করছে না। এক সময় ভারতের মানচিত্রের সিংহভাগ রাজ্যই বিজেপির দখলে ছিল। এখন সিংহভাগ রাজ্যই বিজেপির হাতছাড়া। সেই কারণেই কি বিজেপি বিভিন্ন রাজ্যে বিরোধী সরকার ফেলতে মরিয়া হয়ে উঠেছে?

প্রবীণ রাজনীতিকরা আরও একটি চিন্তার কারণ দেখছেন। তা হল এই সরকার ফেলার চেষ্টায় রাষ্ট্রপতি থেকে রাজ্যপালের দফতরকে খোলাখুলি কাজে লাগানো। গত বছরের ২২ নভেম্বরের রাতের কাণ্ড তার আদর্শ নমুনা। মহারাষ্ট্রে ভোটের পরে কোনও দলই সরকার গঠন করতে না পারায় রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়েছে। ২২ নভেম্বরের এক রাতের মধ্যেই এনসিপি থেকে অজিত পওয়ারকে ভাঙিয়ে আনে বিজেপি। মন্ত্রিসভার বৈঠকের অনুমোদন ছাড়াই জরুরি ভিত্তিতে রাতেই রাষ্ট্রপতি শাসন তুলে নেওয়ার নির্দেশিকা জারি হয়। বাকি দুনিয়ার ঘুম ভাঙার আগেই রাজ্যপালের সামনে মুখ্যমন্ত্রী ও উপ-মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেবেন্দ্র ফডণবীস ও অজিত পওয়ার শপথ নিয়ে ফেলেন। ‘চাণক্য’ অমিত শাহের নামে জয়ধ্বনি ওঠে।

ক্ষমতা দখলের সেই চেষ্টা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। পাল্টা চালে শিবসেনা-কংগ্রেস-এনসিপি নেতারা জোট বেঁধে সরকার গড়ে মাস্টারস্ট্রোক দিয়েছিলেন। মধ্যপ্রদেশে বহু যুদ্ধের পোড়খাওয়া কমল নাথও নানা রকম কৌশলে, কখনও পাল্টা বিজেপির বিধায়ক ভাঙিয়ে গদি বাঁচানোর চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। গুজরাতি ‘চাণক্য’-র সঙ্গে টক্কর দিতে কমলের বুড়ো হাড়ে ভেলকি দেখেও লোকে ধন্য, ধন্য করছে।

২০২০-র ভারতে একটি বিষয় প্রতিষ্ঠিত। ‘ডিল-মেকিং’টাই এখন রাজনৈতিক মাস্টারস্ট্রোক। চোরাশিকারিরাই এ যুগের চাণক্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন