কোনটি বিচার্য 

সুতরাং কেন্দ্রবিরোধী শ্রমিক সংগঠনগুলি তৃণমূল নেত্রীকে কেন্দ্রীয় বিজেপি শাসকের প্রতি নরমমনোভাবাপন্ন বলিয়া যতই গাল দিক, তাহা ব্যুমেরাং হইয়া ফিরিয়া আসিবে। বুঝাইয়া দিবে যে, সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বহুকালের পোড়-খাওয়া নেতা হইয়াও মানিতে অনিচ্ছুক যে, বিজেপির প্রতি সমর্থন ছাড়াও (বাস্তবিক কোনও রাজনৈতিক অভিসন্ধি ছাড়াও) কোনও রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান ধর্মঘটের অংশীদার না-ই হইতে চাহিতে পারেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share:

ধর্মঘট আহ্বান করা একটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। কিন্তু ধর্মঘট সমর্থন না করাও কি রাজনীতিরই কর্মকাণ্ড? না কি তাহার মধ্যে কিছু সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাণ্ডজ্ঞানের বিষয়ও রহিয়াছে? প্রশ্নটি এখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কেন্দ্র করিয়া ঘুরিতেছে। আগামী ৮ ও ৯ তারিখ দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট ডাকিয়াছে কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনগুলি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তাহার বিরোধিতা করিতেছেন। বিরোধিতার অংশ হিসাবে কতকগুলি কঠোর সিদ্ধান্তও লইয়াছেন, যেমন, কর্মীদের হাজিরা বাধ্যতামূলক করা, ধর্মঘটের দিনগুলিতে এবং তাহার আগের ও পরের দিন ছুটি মঞ্জুর না করা ইত্যাদি। পাশাপাশি, ধর্মঘট ব্যর্থ করিবার লক্ষ্যে পরিবহণ স্বাভাবিক রাখিবার অঙ্গীকার শোনা গিয়াছে। এই সব অঙ্গীকার কত দূর পালন সম্ভব, তাহা অবশ্যই ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু একদা বন্‌ধ-জর্জরিত, বিপদগ্রস্ত রাজ্যটিতে যে এইটুকুও আজকাল শোনা যাইতেছে, তাহা কম কথা নহে। ধর্মঘট কেবল না চাহিতে পাইবার ছুটির কু-অভ্যাস মাত্র নহে, অসংখ্য মানুষের আর্থিক ক্ষতির ফলে ইহা হইল সম্মেলক ক্ষতির জোরদার বন্দোবস্ত। বাম আমলের শেষে যখন পশ্চিমবঙ্গে সেই বন্দোবস্ত চিরস্থায়ী হইয়া বসিবার পথে, সেই সময়ে ইহাতে বাঁধ বাঁধিয়াছিলেন বাম-পরবর্তী প্রশাসনের মুখ্যমন্ত্রী। অন্তত এই একটি অভিশাপ হইতে যে এই রাজ্য আংশিক মুক্তি পাইয়াছে, সেই কৃতিত্ব তাঁহাকে না দিয়া উপায় নাই।

Advertisement

সুতরাং কেন্দ্রবিরোধী শ্রমিক সংগঠনগুলি তৃণমূল নেত্রীকে কেন্দ্রীয় বিজেপি শাসকের প্রতি নরমমনোভাবাপন্ন বলিয়া যতই গাল দিক, তাহা ব্যুমেরাং হইয়া ফিরিয়া আসিবে। বুঝাইয়া দিবে যে, সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বহুকালের পোড়-খাওয়া নেতা হইয়াও মানিতে অনিচ্ছুক যে, বিজেপির প্রতি সমর্থন ছাড়াও (বাস্তবিক কোনও রাজনৈতিক অভিসন্ধি ছাড়াও) কোনও রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান ধর্মঘটের অংশীদার না-ই হইতে চাহিতে পারেন। বিশেষ করিয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিমধ্যে এই বিষয়ে বেশ একটি খ্যাতি অর্জন করিয়া ফেলিয়াছেন, বন্‌ধ ঘোষণামাত্রেই তাহা ব্যর্থ করিবার লক্ষ্যে ঘোষিত সরকারি নির্দেশিকাটি যে কেবল কথার কথা নয়, যথেষ্ট সারবান— তাহা তিনি ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। সল্টলেকের সেক্টর ফাইভ নামক আইটি অঞ্চলটি একাই ইহার প্রমাণ। ধর্মঘটের আগের দিন হইতে যে ভাবে পরের দিনের কাজের তোড়জোড় শুরু হয়, যে ভাবে কর্মীরা কর্মস্থানে রাত পার করিয়া থাকিয়া যান, তেমন উদ্দীপনা দশ বৎসর আগে অভাবনীয় ছিল।

ইহার পর একটি প্রশ্ন থাকিয়া যায়। কাজ যে হেতু কাজ, এবং কাজের ক্ষতি মাত্রেই যে হেতু অগ্রহণযোগ্য— সেই যুক্তিতে ধর্মঘট আর ছুটির মধ্যে কি বড় কোনও ফারাক আছে? কী বলেন মুখ্যমন্ত্রী? তিনি কি বিষয়টি ভাবিয়া দেখিয়াছেন? এক দিকে তিনি ধর্মঘট আটকাইতেছেন, অন্য দিকে রাজ্য ছুটি-তালিকার কলেবরটি তাঁহার আমলে পূর্বাপেক্ষা দীর্ঘতর হইয়াছে, প্রায় অক্ষমণীয় ভাবে। পূজার মরসুম এখন পাঁচ দিনের বদলে পনেরো দিনে গিয়া ঠেকিবার জোগাড়। যে কোনও ছুটি শুক্রবার বা সোমবার ফেলিয়া, শনি-রবির সঙ্গে আরও একটি দিন জুড়িয়া, দিঘা-শান্তিনিকেতনের বন্দোবস্ত করিতে বর্তমান রাজ্য প্রশাসন সিদ্ধহস্ত। অবশ্যই মানুষ এই ‘বিবেচনাবোধ’ দেখিয়া খুশি হন। কিন্তু এই বিবেচনা কি শেষ পর্যন্ত কর্মদিবস কমাইয়া, কর্মসংস্কৃতি নষ্ট করিয়া, রাজ্যের ক্ষতি করে না? বাস্তবিক, এই যুক্তি তুলিয়া যদি বিরোধীরা ধর্মঘট-বিরোধিতার মধ্যে রাজনীতি খোঁজেন, দোষ দেওয়া যায় কি? কাজ না হইলে ক্ষত যত ক্ষতি যত— সবই সমাজ ও অর্থনীতি বহন করে। ধর্মঘটে কাজ পণ্ড হইলে যে ক্ষতি, অত্যধিক ছুটিতে কাজ বন্ধ হইলেও তাহাই।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন