কিন্তু সরকার তো পাহাড়েরও

অভিজ্ঞ নাগরিক খেয়াল করিয়ে দেবেন, বাঙালি দার্জিলিঙে বেড়াতে না গেলে ওরাই বা কী করে চালাবে? পর্যটকরাই তো ওদের আয়ের একটা বড় উৎস? প্রাজ্ঞ নাগরিক বলবেন, বুঝবে তখন! পেটের ভাত বন্ধ হলে সব আন্দোলনও বন্ধ হয়ে যাবে।

Advertisement

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০১৭ ০০:০০
Share:

পাহাড়ে অশান্তি শুরু হওয়ার পর থেকেই সমতলের মন খারাপ— টুক করে একটু কেভেন্টার্স আর গ্লেনারিজ ঘুরে আসার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল! যাই বা না যাই, ‘চলে গেলে বেশ হত’ ভাবতে ভাবতে চলে না-যাওয়ার পবিত্র বেদনা উপভোগ করব— এই খাঁটি মধ্যবিত্ত বাঙালি দুঃখবিলাসটুকুও কেড়ে নেবে ওরা! কী অন্যায়! এই মরশুমে ক্ষোভের মাত্রা কিছু বেশি, অন্তত আড়াই গুণ। কাশ্মীর গিয়েছে, এখন দার্জিলিংও গেল, এ বার বুঝি তার টানে সিকিমও যায়-যায়। এই আশ্বিনের শারদপ্রাতে বাঙালি তবে যাবে কোথায়?

Advertisement

অভিজ্ঞ নাগরিক খেয়াল করিয়ে দেবেন, বাঙালি দার্জিলিঙে বেড়াতে না গেলে ওরাই বা কী করে চালাবে? পর্যটকরাই তো ওদের আয়ের একটা বড় উৎস?

প্রাজ্ঞ নাগরিক বলবেন, বুঝবে তখন! পেটের ভাত বন্ধ হলে সব আন্দোলনও বন্ধ হয়ে যাবে।

Advertisement

এবং সর্বজ্ঞ নাগরিক নিদান দেবেন, ওতে কিছু হবে না, ওরা ঠিক চালিয়ে যাবে, ওদের চেনো না।

— পাহাড় এখন বড় খবর। মিছিল অবরোধ বন্‌ধ সংঘর্ষ বোমা গুলি খুন জখম আগুন। এবং রাজনীতি। যে রাজনীতি চলাচল করছে দার্জিলিং থেকে কলকাতা, কলকাতা থেকে দিল্লি। যে রাজনীতিতে নানান দল আর উপদল নিজের নিজের তাগিদ অনুসারে কাজ এবং অকাজ করে চলেছে, বিভিন্ন মাপের নায়কনায়িকারা নিজের নিজের খেলা খেলছেন। সে খেলার শেষ কোথায়, কখন, কী ভাবে, তাঁরা নিজেরাও আর জানেন না। আপাতত অশান্তি চলছে, চলবে।

সেই অশান্তির মার যাঁদের সবচেয়ে বেশি খেতে হচ্ছে— চিরকালই যেমনটা হয়— তাঁরা পাহাড়ের সাধারণ মানুষ। এবং, চিরকালই যেমনটা ঘটে, তাঁদের খবর আমরা, পাহাড়প্রেমী বঙ্গীয় নাগরিকরা, রাখি না। পশ্চিমবঙ্গের পাহাড়ে সাধারণ মানুষ গত দেড় মাস কেমন আছেন, কী ভাবে দিন কাটাচ্ছেন তার খবর, এই সংবাদ-বিস্ফোরণের যুগেও, খুব বেশি পাবেন না। তবে যেটুকু পাবেন, সেইটুকুই নির্ভুল ভাবে জানিয়ে দেবে যে, পরিস্থিতি অতি কঠিন। এমনিতেই পাহাড়ের জীবন সমস্যায় দীর্ণ, তার ওপর দীর্ঘ সময় ধরে এই উপদ্রব, খাবারদাবার থেকে ওযুধপত্র, সব কিছুরই অনটন বাড়ছে। তার ওপর যানবাহনের আকাল, আর বর্ষার পাহাড়ে রাস্তার ক্ষয়ক্ষতি দ্রুত মেরামত না হলে যাতায়াত বিপর্যস্ত। স্কুলের পড়াশোনা শিকেয়। এবং হোটেল-রেস্তোরাঁ, দোকানপাট, চা-বাগান, সর্বত্র কাজ বন্ধ, সুতরাং উপার্জন বন্ধ। এমনিতেই দিন আনি দিন খাই, তাই এই দুর্দিনে পাহাড়ের মানুষ কেমন থাকতে পারেন, সেটা নিছক কাণ্ডজ্ঞানই বলে দেয়।

কিন্তু ওদের জন্যে আমরা আমাদের মূল্যবান কাণ্ডজ্ঞান খামকা খরচ করতে যাব কেন? বরং কেউ সে-কথা মনে করিয়ে দিতে এলে সপাটে জবাব দেব— বেশ হয়েছে, আরও ভুগুক, তা হলে বুঝবে গোর্খাল্যান্ডে কত ধানে কত চাল হয়।

পাহাড়ের সাধারণ মানুষের কত শতাংশ সত্যিই গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের সমর্থক আর কত শতাংশ চাপে পড়ে সেই আন্দোলনে সায় দিচ্ছেন, জানি না, জানতে পারব এমন ভরসাও নেই— পরস্পর জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখেছি, যে যার মনের মাধুরী মিশিয়ে এ বিষয়ে একটা মত খাড়া করেন এবং তার পরে, অনেকটা মোল্লা নাসিরুদ্দিনের স্টাইলেই, সেই মতটাকে একমাত্র সত্য বলে ধরে নিয়ে তার পিছু পিছু হাঁটেন। তাই এ বিষয়ে সত্যাসত্যবিনিশ্চয়ের চেষ্টা করব না।

কেবল একটাই প্রশ্ন মনের মধ্যে পাক খায়। মহামান্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্দেশে সেটি নিবেদন করি। সরকার তো, যত দূর জানি, সকলের। যেমন সমতলের, তেমনই পাহাড়েরও। তা, পাহাড়ের মানুষ— গোর্খাল্যান্ড চান বা না চান— দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস এমন দুর্দশা যাপন করতে বাধ্য হলে সরকারের ওপর তার নৈতিক দায় এসে পড়ে না কি? আন্দোলন যে দিকেই যাক, সেই আন্দোলন মোকাবিলায় সরকার যা-ই করুক, পাহাড়ের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা তো রাজধর্মের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ? গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের নেতারা সে-সব নিয়ে মাথা না ঘামাতে পারেন, গণতান্ত্রিক সরকার তার দায় এড়ায় কী করে?

আশঙ্কা হয়, কেবল দায় এড়ানো নয়, সরকারের ধ্যানধারণায় হয়তো একটি রণকৌশলও নিহিত আছে। সেটা এই যে, আন্দোলন যত দিন চলে চলুক, দুর্গতি সহ্য করতে করতে মানুষই এক সময় প্রতিবাদ করবে, তখন আন্দোলনের কারিগররা আপস কিংবা আত্মসমর্পণ করবে। পাটোয়ারি বুদ্ধি হিসেবে এই হিসেব কতটা কার্যকর, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। গত কয়েক বছরে পাহাড়ের যে মানুষরা সমতলের কিছুটা কাছে আসছিলেন, এই ধারাবাহিক দুর্দশা এবং সরকারি ঔদাসীন্য তাঁদের অনেক দূরে সরিয়ে দিতে পারে, বিশেষ করে কাছের ও দূরের সুযোগসন্ধানীরা যখন তাঁদের সেই অসন্তোষে বিস্তর ধোঁয়া দিচ্ছেন, পাশাপাশি কিছু খাবারদাবার ইত্যাদি দিয়ে তাঁদের পাশেও থাকছেন। কিন্তু হিসেব ঠিক হোক বা ভুল, একটা ব্যাপার জোর দিয়ে বলা যায়, এবং বলা দরকার। এই কৌশল যুদ্ধের হতে পারে, সুশাসনের নয়। নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে সুশাসন চলতে পারে না।

এবং এ ক্ষেত্রে আমাদের চেনাজানা গণতন্ত্রের ওপর ভরসা করে কোনও লাভ নেই, সে চলে সংখ্যার নিয়মে। ঘটনা হল, সমতল সংখ্যাগুরু, পাহাড় সংখ্যালঘু। সমতলের বাঙালি পাহাড়কে বেড়ানোর জায়গা হিসেবে দেখে এসেছে, দেখে যাবে। সেখানকার মানুষ কেমন আছেন তা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই, থাকবে না। সুতরাং সংখ্যাগুরুর গণতন্ত্র সরকারকে পাহাড়ের মানুষের দায় স্বীকার করতে বলবে না, বরং উল্টো চাপই দেবে। কিন্তু নৈতিকতা সংখ্যার হিসেব মানে না। সমতলের সমস্ত ভোটদাতা যদি সমস্বরে বলে, ‘ওদের টাইট দেওয়া হোক, তবেই ওরা বশ মানবে’, তা হলেও সেই পরামর্শ সমান অনৈতিক থেকে যায়।

পশ্চিমবঙ্গ সরকার সংখ্যাগুরুর অবস্থান থেকেই পাহাড়কে দেখবে, না নৈতিকতার সত্যমূল্য চুকিয়ে যথার্থ গণতন্ত্রকে অর্জন করবে, সেটা তারই সিদ্ধান্ত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন