শক্তিস্তম্ভে আঘাত

ভারতের পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক মহলকেও উদ্বিগ্ন করিয়াছে। কাশ্মীরে আজও বিদেশি সাংবাদিকের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি আছে। ভারতীয় সাংবাদিকদের স্বাধীনতাও ব্যাহত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৯ ০০:১৯
Share:

উত্তর কোরিয়া এক ধাপ আগাইয়াছে, দুই ধাপ পিছাইয়াছে ভারত। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে ভারতের পতন অপ্রতিহত। একশত আশিটি দেশের মধ্যে তাহার স্থান একশত চল্লিশ। সাংবাদিকদের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’ এই সূচক প্রকাশ করে। ২০১৯ সালের রিপোর্ট সতর্ক করিয়াছে, এই সাধারণ নির্বাচন সাংবাদিকদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হইবে। রাজ্যবাসী তাহার প্রমাণ ইতিমধ্যেই পাইয়াছেন। নির্বাচনের দ্বিতীয় দফাতেই বুথ দখলের খবর করিতে গিয়া নিগৃহীত হইয়াছেন সাংবাদিক, ক্যামেরা ভাঙিয়াছে আলোকচিত্রীর। আক্ষেপ, সাংবাদিকের উপর আক্রমণ যেন ‘স্বাভাবিক’ হইয়া উঠিতেছে। গত এক দশকে এই রাজ্যে এমন একটিও নির্বাচন হয় নাই, যেখানে সাংবাদিক নিগৃহীত হন নাই। পুরসভা কিংবা পঞ্চায়েত নির্বাচন হইলেও সাংবাদিকের মাথা ফাটাইয়া, ক্যামেরা ভাঙিয়া, জবরদস্তি ঘরবন্দি করিয়া, মহিলা সাংবাদিকদের হেনস্থা করিয়া শাসক দলের কর্মীরা তাহাদের সক্রিয়তার সাক্ষ্য রাখিবে। বুথ দখল কিংবা ইভিএম লুটের ন্যায়, সাংবাদিক নিগ্রহও ভোটের একটি আচার হইয়া উঠিয়াছে। রাজ্য প্রশাসন এক বারও সুবিচারের প্রতিশ্রুতি দেয় নাই। আশ্বাসও দেয় নাই যে, এমন আর ঘটিবে না। এই পরিস্থিতি দেশের সর্বত্র। রিপোর্ট বলিতেছে, গত বৎসর ভারতে অন্তত ছয় জন সাংবাদিক তাঁহাদের কাজের সূত্রে প্রাণ হারাইয়াছেন। ২০১৭ সালে সেই সংখ্যাটি ছিল তিন।

Advertisement

ভারতের পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক মহলকেও উদ্বিগ্ন করিয়াছে। কাশ্মীরে আজও বিদেশি সাংবাদিকের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি আছে। ভারতীয় সাংবাদিকদের স্বাধীনতাও ব্যাহত। রিপোর্ট বলিতেছে, ভারতে সংবাদ-পরিবেশের বৈশিষ্ট্য হল সাংবাদিকদের উপর হিংস্র আক্রমণ। কেবল রাষ্ট্রের হিংসা নয়, মাওবাদী যোদ্ধা, দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা, মাফিয়া ও অপরাধচক্র, সকলেরই আক্রমণের লক্ষ্য সাংবাদিক। সর্বোপরি, প্রধানমন্ত্রী মোদীর বিরোধিতা করিয়া সংবাদ প্রকাশ করিলেই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সমাজমাধ্যমে সুপরিকল্পিত ভাবে বিদ্বেষবার্তার প্রচার করে হিন্দুত্ববাদীরা। প্রত্যহ অজস্র হিংস্র, ধর্ষকামী বার্তার মোকাবিলা সহজ নহে। সহকর্মীদের বিপর্যস্ত হইতে দেখিয়া বহু সাংবাদিক সরকার-বিরোধী তথ্য ও মত প্রকাশ হইতে স্বেচ্ছায় বিরত হইতেছেন। সাংবাদিকের এই স্বেচ্ছা-সীমাবদ্ধতা গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক। সরকারের কাজের ভাল-মন্দ না জানিলে-বুঝিলে নাগরিক তাহার মূল্যায়ন করিবে কী প্রকারে? সাংবাদিক বেতনভোগী কর্মী, কিন্তু তাঁহার কাজের সহিত জনস্বার্থের সাক্ষাৎ সম্পর্ক রহিয়াছে। এই জন্যই নির্বাচনের পূর্বে সাংবাদিকদের উপর বিজেপি কর্মীদের ক্রমবর্ধমান আক্রমণে উদ্বেগ প্রকাশ করিয়াছে আন্তর্জাতিক রিপোর্ট। বলিয়াছে যে, গ্রামীণ এলাকায় ভারতীয় ভাষার সংবাদমাধ্যমগুলিতে কর্মরত সাংবাদিকের বিপন্নতা অধিক।

কিন্তু সংবাদ বিপন্ন হইয়াছে কি? এই আন্তর্জাতিক রিপোর্ট কেবল সাংবাদিকতার পরিবেশের মূল্যায়ন করে, সংবাদের নহে। ভারতীয় সাংবাদিকের বিপন্নতা অবশ্যই বাড়িয়াছে। কিন্তু এত ভয় দেখাইয়াও সংবাদ হইতে সরকারের বিরোধিতা নির্মূল করা যায় নাই। ধামা ধরিবার লোকের কখনওই অভাব হয় নাই, আজ হয়তো তাহারা সংখ্যায় বাড়িয়াছে। কিন্তু সত্য বলিবার লোকেরও কখনও অভাব হয় নাই ভারতে। নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের ব্যর্থতা, বিবিধ সাফল্যের দাবির অসারতা, দুর্নীতি রুখিতে ব্যর্থতা, বিদ্বেষমূলক রাজনীতির অন্যায্যতা সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত প্রকাশিত হইতেছে। আজ ভারতে যে নির্বাচন চলিতেছে তাহা গণতন্ত্রের অভিনয়মাত্র নহে। বিবিধ রাজনৈতিক দলের বাস্তব প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তাহাতে সাংবাদিকের অবদানও কম নয়। ব্যক্তি সাংবাদিকের শক্তি সামান্য, কিন্তু সংবাদের শক্তি কম নহে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement