অবজ্ঞা ও উদাসীনতার ফল 
India Lockdown

কে বলবে, খাদ্যের অধিকার নামে একটা আইন আছে এই দেশে

লকডাউন ঘোষণার পর এক মাস পেরোল, কেন্দ্র পরিযায়ী শ্রমিকদের খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে টুঁ শব্দটি করল না। যত দিন যাচ্ছে, খাদ্যাভাব তীব্র হচ্ছে।

Advertisement

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০২০ ০০:০১
Share:

টাইটানিক ছবিটা মনে আছে? জাহাজ যখন ডুবতে বসেছে, তখন এক সম্ভ্রান্ত মহিলা বলেছিলেন, “লাইফবোটে ফার্স্ট ক্লাসকে আলাদা বসতে দেবে তো?” আজ রাজস্থানের কোটা থেকে ছাত্রছাত্রীরা যে সব বাসে ফিরছে, কিংবা যে বিশেষ ফ্লাইটে দিল্লি থেকে ফিরলেন সাংসদের স্ত্রী, সেগুলো তো আসলে ফার্স্ট ক্লাস লাইফবোট। ভিনরাজ্যে কাজে যাওয়া মজুরের ভরসা পা দুটো। শ্রমদিবসে ওড়িশার ময়ূরভঞ্জের কোয়রান্টিন থেকে বিতাড়িত হলেন একত্রিশ জন বাঙালি মজুর। পায়ে হেঁটে মেদিনীপুর চকসুলিয়াপাড়া সীমান্তে এসে বসে রইলেন রাস্তাতেই। বর্ডার পেরোনোর অর্ডার আসেনি।

Advertisement

তার ক’দিন আগে ঝাড়খণ্ডের পুলিশ সে রাজ্যে কোয়রান্টিনে থাকা বাঙালি শ্রমিকদের ছেড়ে দিয়ে যায় বীরভূমের রাজনগরের সীমান্তে। পুলিশ তাঁদের ঢুকতে দেয়নি। সারা রাত বৃষ্টিতে ভিজে গাছতলায় কাটিয়ে পর দিন তাঁরা হাঁটতে হাঁটতে যান পাথরচাপড়িতে। তার পর আর খবর নেই। কোন রাজ্যে কী নীতি, তাঁরা ঠাহর করতে পারছেন না। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশার শ্রমিকরা বাস ভরে ফিরে যাচ্ছে, বেঙ্গালুরু কি সুরাতের বস্তিতে বসে তা দেখছেন বাংলার পরিযায়ী শ্রমিক। এ দিকে মারণভাইরাস, ও দিকে পুলিশের লাঠির ভয়ে শীর্ণ হতে হতে।

লকডাউনের এক মাস পর কেন্দ্র হুকুম করল, এ বার বাড়ি ফেরাও পরিযায়ী শ্রমিককে। শুরু হল নতুন উদ্বেগ। এত লোক ফিরবে কী করে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নবান্নে বলেছেন, দু’লক্ষ মজুর রয়েছে বাইরে। “কিন্তু কেবল মুর্শিদাবাদ থেকেই তো দু’লক্ষ শ্রমিক বাইরে যায়,” বললেন শ্রম দফতরের এক আধিকারিক। পরিযায়ী ও অভিবাসী মানুষদের নিয়ে দীর্ঘ দিন কাজ করছে ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ। কর্ণধার রণবীর সমাদ্দারের মতে, যথাযথ সংখ্যা আন্দাজ করা দুঃসাধ্য। তবু নির্মাণশিল্প, বস্ত্রশিল্প, গয়নাশিল্প প্রভৃতির তথ্য এবং জাতীয় স্তরের নানা সমীক্ষার পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে তাঁর আন্দাজ, সারা ভারতে এই সংখ্যাটা হবে আশি লক্ষ থেকে এক কোটি। এর মধ্যে অন্তত ১০ লক্ষ পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিক।

Advertisement

যদি এর অর্ধেকও আটকে গিয়ে থাকেন, সংখ্যাটা পাঁচ লক্ষ। এত দিন কী ভাবে কাটালেন এই লোকগুলো? ঠিকাদার বা মালিক মোবাইল সুইচ অফ করে রেখেছে, হাতের টাকা শেষ, রোজগারের পথ বন্ধ। প্রথম প্রথম বিভিন্ন রাজ্যের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি এগিয়ে এসেছিল খাবার নিয়ে। ক্রমে তাদের রসদ ফুরিয়েছে।

এপ্রিলের শেষে মুম্বইয়ে আটকে-পড়া শ্রমিক রেজ্জাক হুসেন সাহায্যের আবেদনে লিখেছেন, “পাশে একটা মার্কেটে খাবার দেওয়া হচ্ছিল, সেটা এখন বন্ধ হয়ে গেছে। তার পরে একটা সোসাইটি থেকে কয়েক দিন খাবার দেওয়ার পর সেটাও তারা বন্ধ করে দিয়েছে। তারা বলেছে, ‘‘আমরা আর খাবার দিতে পারব না কারণ তোমাদের মতো অনেক মজদুরকে এখন খাবার দিতে হচ্ছে। খাবারের সন্ধানে বাইরে গেলে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং না হওয়ার কারণে পুলিশ লাঠি মারে।’’ ফলে খাবার না পেয়েই এঁদের ফিরতে হচ্ছে।

এই দেশ যে খাদ্যের অধিকার নামে একটা আইন পাশ করেছে, সে স্মৃতিই যেন বিলুপ্ত। লকডাউন ঘোষণার পর এক মাস পেরোল, কেন্দ্র পরিযায়ী শ্রমিকদের খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে টুঁ শব্দটি করল না। যত দিন যাচ্ছে, খাদ্যাভাব তীব্র হচ্ছে। লকডাউনের একুশ দিনের মাথায় নানা রাজ্যে আটকে-পড়া ১১ হাজার শ্রমিকের তথ্য নিয়ে একটি সমীক্ষা প্রকাশিত হয়। তখনই অর্ধেক শ্রমিকের কাছে আর এক দিনের মতো খাবারও অবশিষ্ট ছিল না। ছিয়ানব্বই শতাংশ সরকারের থেকে কোনও রেশন পায়নি।

‘স্ট্র্যান্ডেড ওয়ার্কার্স অ্যাকশন নেটওয়ার্ক’-এর এই সমীক্ষায় ধরা পড়েছিল, ক্ষুধার্তের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে, ত্রাণের হার সে হারে নয়। যাদের এক দিনেরও কম মজুত খাবার আছে, তেমন পরিযায়ী শ্রমিক লকডাউনের প্রথম থেকে তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে বেড়ে গিয়েছিল ছত্রিশ থেকে পঞ্চাশ শতাংশে, কিন্তু সরকারি রেশন-পাওয়া শ্রমিক বেড়েছে এক শতাংশ থেকে চার শতাংশে।

পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য হেল্পলাইন চালাচ্ছে বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ। মুখপাত্র সামিরুল ইসলাম জানালেন, ওড়িশা, কেরল, পঞ্জাব, রাজস্থান, ঝাড়খণ্ডে সরকার ক্ষুধার্ত শ্রমিকদের সন্ধান পেলে তবু সাহায্য করছে। বিহার আর গুজরাতে প্রশাসনের কর্তারা সরাসরি বলে দিচ্ছেন, তোমাদের মজুরদের আমরা কেন খাওয়াব? বেসরকারি তরফেও এই প্রশ্ন উঠছে। বেঙ্গালুরুতে বাঙালি শ্রমিকদের একটি দল তিন দিন শুধু জলমুড়ি খেয়ে আছে, শুনে আজিম প্রেমজি ট্রাস্টের এক কর্তা সহায়তা পাঠাতে রাজি হলেন। তবে সেই সঙ্গে বললেন, “খাদ্যপ্রার্থীর সংখ্যা রোজ বেড়ে যাচ্ছে। এখন আমরা রোজ ষোলো লক্ষ মানুষকে খাওয়াচ্ছি, দৈনিক খরচ ২০-২১ কোটি টাকা। তাই প্রশ্ন করতে বাধ্য হচ্ছি, যেখানকার শ্রমিক, সেই রাজ্য কেন দায়িত্ব নেবে না?”

কেন্দ্রের ভূমিকা নেওয়ার কথা ছিল এইখানেই। পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা সব রাজ্যে সমান নয়, তাই ব্যয়ভারের সমবণ্টন হচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে বাইরের দু’লক্ষ শ্রমিক, বেঙ্গালুরুতে অন্তত তেইশ লক্ষ। কী ভাবে রাজ্যগুলির আর্থিক দায়বদ্ধতার ভারসাম্য বজায় থাকে, তার উত্তর কেন্দ্রেরই দেওয়ার কথা।

ভুললে চলবে না, এই সঙ্কটের অনেকটা কেন্দ্রেরই উদাসীনতার ফল। মজুরের খাদ্যাভাবের অন্যতম কারণ, এখনও এক রাজ্যের রেশন কার্ড অন্য রাজ্যে ব্যবহার করা যায় না। ‘এক দেশ, এক রেশন কার্ড’, নাকি জুলাই মাস থেকে শুরু হবে। সুপ্রিম কোর্ট ৩০ এপ্রিল কেন্দ্রকে নির্দেশ দিয়েছে, ভিনরাজ্যে আটকে-থাকা শ্রমিকদের জন্য এখনই এই প্রকল্প চালু করতে। অথচ কেন্দ্রেরই নিয়োজিত কমিটি এই সুপারিশ করেছিল তিন বছর আগে। ভারতে ৪৫ কোটি মানুষ নিজের জেলা বা রাজ্যের বাইরে কোথাও থাকেন। সংবিধান নাগরিককে যেখানে ইচ্ছে যাওয়ার অধিকার দিয়েছে, কিন্তু কাজের বেলা কেউ নিজের রাজ্য ছাড়লেই নাগরিকের সুযোগ-সুবিধে হারান। আজ যদি পরিযায়ী শ্রমিকদের রেশন কার্ড সর্বত্র কার্যকর হত, তা হলে গণবণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে কোথায় কত চাহিদা তার আন্দাজ মিলত, জোগানের রাস্তাও থাকত।

খাদ্যনীতি যেমন পরিযায়ী শ্রমিকের প্রয়োজন বাদ রেখেছে, তেমনই নগরায়ণ নীতি বাদ রেখেছে তার উপযুক্ত বাসস্থানকে। সস্তায় ভাড়া বাড়ি, সুলভে জল-বিদ্যুৎ, এই হল শ্রমিকদের প্রধান প্রয়োজন। প্রাক্তন আইএএস অনিতা অগ্নিহোত্রী লিখছেন, ভাড়াবাড়ির বাজারটি এখন প্রায় পুরোটাই কালোবাজার। অসংখ্য বস্তি, ঝুপড়ি ও অস্থায়ী বাসস্থানের ভাড়া যাঁরা আদায় করেন, তাঁরা স্থানীয় তোলাবাজ। পুরসভা এক পয়সা পায় না। তাঁর অভিজ্ঞতা, ‘স্মার্ট সিটি’র পরিকল্পনার সময়ে ছিল ‘সবার জন্য ঘর’ প্রকল্পটি, যেখানে সামান্য ভাড়ায় ঘরের প্রস্তাব ছিল। শেষ পর্যায়ে তা খসড়ায় বাদ পড়ে যায়।

পরিযায়ী শ্রমিক বস্তিতে, রাস্তায় থাকতে বাধ্য হন বলে আমরা ভুলে যাই, তাঁরা সবাই হতদরিদ্র নন। বাংলার গ্রাম থেকে যাঁরা কেরল, পুণে, দিল্লিতে যান, তাঁদের অনেকেরই ঘরে দু-চার বিঘে জমি আছে। পুকুর-গরু বা কলাবাগান আছে। দক্ষ শ্রমিক হিসেবে ভিন রাজ্যে তাঁরা যা রোজগার করছেন, তাই দিয়ে সন্তানের প্রাইভেট স্কুলের ফি হচ্ছে, গ্রিল-দেওয়া বাড়ি, মোটরবাইক হচ্ছে। খাওয়ার জন্য অপমানিত হওয়ার অভ্যাস এঁদের নেই।

সেই কথাটাই বলতে মহম্মদ রিতু শেখ যান থানায়। পূর্ব বর্ধমানের কেতুগ্রাম, মঙ্গলকোট থেকে সুরাতে আসা প্রায় ছ’শো শ্রমিকের জন্য দিনে একবারই গাড়ি আসে ত্রিকমনগরে। “থানায় বললাম, আমরা ভিখিরি নই, চল্লিশ মিনিট হেঁটে গিয়ে শিবিরে কয়েক হাজার লোকের সঙ্গে কাড়াকাড়ি করে খেতে পারব না। এ পাড়ায় কয়েক হাজার বাঙালি শ্রমিক, এখানে দু’বেলা খাবারের ব্যবস্থা করে দিন।’’

থানা রাজি হয়নি। আজ কী খাবার দিল? “আজ খাবার নিতে পারিনি। ইফতারের সময়ে গাড়ি এসে গিয়েছিল। “খেজুর আর পানি দিয়ে ইফতার হয়েছে। গোটাকতক কলা আছে। তাই খেয়ে আরও একটা লকডাউনের রাত কাটবে। বাড়ি ফেরার প্রার্থনায়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন