সম্পাদকীয় ২

উদ্বাস্তু রাজধানী!

‘উদ্বাস্তু রাজধানী’— এই শব্দবন্ধই সুরুচির পরিচয় দেয় না। উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিবার নীতি বা আদর্শের মধ্যে দেশকে উদ্বাস্তু রাজধানী বানাইবার পরিকল্পনা যাঁহারা দেখেন, তাঁহারা অতি সংকীর্ণ রাজনীতি ছা়ড়া কিছুই শিখেন নাই, জানেন নাই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:৫৮
Share:

ভারত কি উদ্বাস্তু রাজধানী হইতে চাহে যে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিবে— প্রশ্ন তুলিয়াছেন কেন্দ্রীয় সরকারের অ্যাডিশনাল সলিসিটর জেনারেল তুষার মেটা। সঙ্গে একটি আতঙ্কের সম্ভাবনাও স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন তিনি। ভারত তাহার দ্বার হাট করিয়া খোলা রাখিলে বিশ্বের সমস্ত দেশের সকল লোক এই দেশে আসিয়া পড়িয়া সংকট বন্যায় দেশকে তলাইয়া দিবে, তাহা কি মানিয়া লওয়া যায়? এই অবস্থানকে দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা বলিয়া আদর করিতে অনেকেই মুক্তকচ্ছ হইবেন, সন্দেহ নাই। তবে দেশপ্রেমের পাশাপাশি এক অপার শিশুসুলভ সারল্যও এই উক্তিতে প্রকট। দ্বার খুলিয়া দিলেও যে পৃথিবীর সব দেশের লোক ভারতে আসিতে না-ই চাহিতে পারেন, এমনকী প্রতিবেশী দেশ হইতেও আক্রান্ত বা উত্খাত বা অত্যাচারিত মানুষ ভিন্ন কেহ তেমন স্বপ্ন না-ই দেখিতে পারেন, মোদীভূমির দেশপ্রেমীরা হয়তো এই সম্ভাবনাতেও বিশ্বাস রাখিতে চাহেন না। কিন্তু প্রশ্ন তাহা নহে। প্রশ্ন হইল, সরকার কি ভারতের উদ্বাস্তু-অবস্থান লইয়া এত বড় একটি কথা বলিবার আগে অগ্রপশ্চাৎ যথেষ্ট বিবেচনা করিয়াছে? সরকারের নীতি উচ্চারণ করিতে গিয়া দেশের নয়া আদর্শ ছকিয়া দিলে প্রশ্ন উঠিবেই, বিশেষত এমন আদর্শ যাহা ইতিহাস-মতে এ-দেশ কোনও কালে মানিয়া আসে নাই?

Advertisement

‘উদ্বাস্তু রাজধানী’— এই শব্দবন্ধই সুরুচির পরিচয় দেয় না। উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিবার নীতি বা আদর্শের মধ্যে দেশকে উদ্বাস্তু রাজধানী বানাইবার পরিকল্পনা যাঁহারা দেখেন, তাঁহারা অতি সংকীর্ণ রাজনীতি ছা়ড়া কিছুই শিখেন নাই, জানেন নাই। তাঁহারা জানেন নাই যে, প্রাচীন কাল হইতে সাম্প্রতিক অতীত পর্যন্ত ভারতবর্ষ প্রয়োজনে আশ্রিতের জন্য দ্বার খোলা রাখিবার পন্থাই লইয়া আসিয়াছে। ‘বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়’ নীতিতে কেবল প্রাচীন শাস্ত্রই মত দেয় নাই, নেহরু শাস্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী মোরারজি দেশাই নরসিংহ রাও এমনকী অটলবিহারী বাজপেয়ী পর্যন্ত সকল প্রধানমন্ত্রীই প্রতিবেশী দেশের আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য উদার নীতি অবলম্বন করিয়াছেন। দেশপ্রেমের হিসাব কষিয়া এই সকল দেশনেতাকে নিচু স্থানে রাখিয়া বর্তমান শাসকদের উচ্চ স্থানে বসাইবার আগে দেশবাসী অবশ্যই ভাবিবেন, কেন, কোন মতাদর্শের উপর নির্ভর করিয়া বিপন্ন মানুষকে আশ্রয় দিবার কথা এই রাষ্ট্র এত দিন ভাবিয়াছে, এবং এখন কেনই বা ভাবিতেছে না।

উত্তর খুঁজিতে বেশি বেগ পাইতে হয় না। ভারতীয় সংবিধানমতেও বিপন্ন বা আক্রান্ত উদ্বাস্তুকে স্থান দেওয়া একটি মৌলিক মানবিক নীতি হিসাবেই গণ্য হইয়াছে, ইহার অন্যথা ভাবাই বরং মুশকিল। শরণার্থীকে স্থান না দিয়া ফিরাইয়া দিবার কথা বর্তমান সরকার ভাবিতেই পারে, কিন্তু তাহার জানা উচিত যে আবহমান কালের ভারতীয় প্রথা, এবং স্বাধীন ভারতের প্রণীত আদর্শের বিপক্ষে গিয়া সে এই কাজ করিতেছে। রোহিঙ্গাদের ধর্মপরিচয় বিজেপি সরকারের পছন্দ নহে বলিয়া ভারতভূমিতে তাহাদের পা না রাখিতে দিবার এই নীতির মধ্যে তাই সংকীর্ণ হিন্দুত্ববাদী রক্ষণশীলতা ছা়ড়া কোনও উচ্চ আদর্শের সন্ধান অতএব না করাই ভাল। সরকারি কর্তাদের জানা উচিত, ভারতীয় রাষ্ট্রীয়তার ভাবাদর্শটি নিজেদের দায়িত্বে তাঁহারা পালটাইতে পারেন, কিন্তু ভারত ইতিহাস পালটাইয়া দিতে পারেন না।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন