দায়

জনগণের স্মৃতি চিরকালই ক্ষীণ। সেই সুযোগে নেতারা যখন যেমন সুবিধা যুক্তি সাজাইয়া পার পাইতেন। কিন্তু, ইন্টারনেট নামক দানব আসিয়া খেলাটি আমূল বদলাইয়া দিয়াছে। ইন্টারনেট কিছু ভোলে না। এবং, সমুদ্রের ন্যায় ইন্টারনেটও প্রতিটি ভাসিয়া যাওয়া কথাকে তীরে ফিরাইয়া দেয়। যেমন ভাসিয়া আসিতেছে জনৈক চটুল উপন্যাস-লেখকের কথা; সরকারের বদান্যতায় যমুনার সর্বনাশ করিয়া আর্ট অব লিভিং-এর শিবির করা ধর্মগুরুর বাণী; দন্তমঞ্জন হইতে বিস্কুট, সব পণ্যের বিক্রেতা আর এক স্বঘোষিত বাবার উক্তি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০১৮ ০০:০০
Share:

আবার পড়ল টাকার দাম।

তৈলাক্ত বংশদণ্ডে বানরের ন্যায় টাকার দামও কেন ক্রমেই পিছলাইয়া নামিতেছে, নরেন্দ্র মোদী ও তাঁহার রাজনৈতিক সহযোগীদের নিকট তাহার ব্যাখ্যা মজুত আছে। তাঁহারা জানাইয়া দিবেন, তুরস্কের মুদ্রার মূল্যহ্রাসের ফলেই আন্তর্জাতিক বাজারে ধাক্কা লাগিয়াছে। গোটা উন্নয়নশীল দুনিয়াতেই মুদ্রার দাম নিম্নগামী। তাঁহারা দক্ষিণ আফ্রিকার মুদ্রার পতনের কথা শুনাইয়া দিবেন। বলিবেন, ভারতে সেই তুলনায় তেমন ধাক্কা লাগে নাই। বিশ্বব্যাঙ্কের ভূতপূর্ব মুখ্য অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর কথা উদ্ধার করিয়া তাঁহারা জানাইয়া দিতে পারেন, ডলার প্রতি ৭০-৭১ টাকাই ভারতীয় মুদ্রার যথার্থ দাম। তাহাতে রফতানিতে গতি আসিবে, কর্মসংস্থান হইবে। এবং, টাকার পড়তি দাম লইয়া দুশ্চিন্তার বিশেষ কোনও কারণ নাই। বিরোধীদের আক্রমণের মুখেও প্রধানমন্ত্রী এখনও অবধি তাঁহার চর্চিত নীরবতা বজায় রাখিতে পারিয়াছেন বটে, কিন্তু মুখ খুলিলে— আন্দাজ করা যায়— এই কথাগুলিই শোনা যাইবে। অন্তত, তাঁহার শুভাকাঙ্ক্ষীরা যুক্তিগুলি সাজাইতেছেন। তাহাতে ভুল নাই, শুধু একটি প্রশ্ন আছে। ডলারের সাপেক্ষে টাকার দাম কমিলে যে তাহাতে বেশির ভাগ সময়ই অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির দায় থাকে না, এই কথাটি আজ যতখানি সত্য, ২০১৩ সালেও ঠিক ততখানিই সত্য ছিল। ইউপিএ-র বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাইবার সময় তাহা স্মরণে আসে নাই কেন? এখন বিরোধীরা টাকার দাম লইয়া চাপিয়া ধরিলে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির দোহাই দিবার পূর্বে অতীতের দায় চুকাইতে হইবে বইকি।

Advertisement

জনগণের স্মৃতি চিরকালই ক্ষীণ। সেই সুযোগে নেতারা যখন যেমন সুবিধা যুক্তি সাজাইয়া পার পাইতেন। কিন্তু, ইন্টারনেট নামক দানব আসিয়া খেলাটি আমূল বদলাইয়া দিয়াছে। ইন্টারনেট কিছু ভোলে না। এবং, সমুদ্রের ন্যায় ইন্টারনেটও প্রতিটি ভাসিয়া যাওয়া কথাকে তীরে ফিরাইয়া দেয়। যেমন ভাসিয়া আসিতেছে জনৈক চটুল উপন্যাস-লেখকের কথা; সরকারের বদান্যতায় যমুনার সর্বনাশ করিয়া আর্ট অব লিভিং-এর শিবির করা ধর্মগুরুর বাণী; দন্তমঞ্জন হইতে বিস্কুট, সব পণ্যের বিক্রেতা আর এক স্বঘোষিত বাবার উক্তি। ২০১৪ সালে তাঁহারাই ছিলেন নরেন্দ্র মোদীর নাগরিক মুখ। সেই আমলে তাঁহারা টাকার দাম নিয়ন্ত্রণে ইউপিএ সরকারের ব্যর্থতায় তিতিবিরক্ত ছিলেন, এবং নিশ্চিত ছিলেন যে ছাপ্পান্ন ইঞ্চির মহানায়ক প্রধানমন্ত্রীর তখ্‌তে বসিলেই ডলার নামিয়া ৪০ টাকায় ঠেকিবে। দুর্জনে বলিবে, সেই সুচতুর প্রচারের সুফল তাঁহারা পাইয়াছেন। চার বৎসরে তাঁহাদের বিলক্ষণ উন্নতি হইয়াছে। দেশবাসী? ‘অচ্ছে দিন’-এর অপেক্ষায়।

কেন ‘অচ্ছে দিন’-এর স্বপ্নটি সম্পূর্ণ অলীক প্রতিপন্ন হইল? তাহার কারণ, বস্তুটি নির্মিত হইয়াছিল অর্থনীতির প্রশ্নকে রাজনীতির খেলায় পরিণত করিবার মাধ্যমে। নরেন্দ্র মোদী না-ও জানিতে পারেন, কিন্তু তাঁহার তৎকালীন উপদেষ্টারা বিলক্ষণ জানিতেন, টাকা অথবা পেট্রোপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করিবার সাধ্য তাঁহার কেন, কোনও রাজনীতিকেরই নাই। সেই প্রতিশ্রুতি দেওয়ার অর্থ, দেশের মানুষের সহিত ডাহা মিথ্যাচার। রাজনীতির মিথ্যাচার। সাধারণ মানুষ অর্থনীতির জটিল যুক্তিতর্ক বোঝে না। তাহারা নেতাকে বিশ্বাস করিতে চাহে। সেই বিশ্বাসের সুযোগ লইয়া ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী যাহা করিয়াছিলেন, তাহাতে সিকি ভাগও সততা ছিল না। চার বৎসরে সেই মিথ্যাচারের স্বরূপ উদ্‌ঘাটিত। ডলারের সাপেক্ষে টাকার দাম নিয়ন্ত্রণ করিতে না পারায় তাঁহাকে দোষ দেওয়ার নহে। কিন্তু, পারিবেন বলিয়া যে প্রতিশ্রুতিটি তিনি দেশের মানুষকে দিয়াছিলেন— অসম্ভব জানিয়াও যে কথা বলিতে তিনি দ্বিধা করেন নাই— আজ তাহার দায় অস্বীকার করিবেন কী উপায়ে?

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন