Editorial News

সন্ধিক্ষণের ইঙ্গিত এল কর্নাটক থেকে

কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন এইচ ডি কুমারস্বামী। নির্বাচনের ফলাফল বলেছে, একক বৃহত্তম দল বিজেপি। কিন্তু ফল এও বলেছে যে, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ নয় বিজেপি। দিল্লির মসনদে গৈরিক ধ্বজা উড্ডীন হওয়ার পর থেকে এ যাবৎ একাধিক রাজ্যের নির্বাচনে এই রকমই ত্রিশঙ্কু ফলাফল এসেছে।

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৮ ০০:৩৬
Share:

এক মঞ্চে বিজেপি বিরোধী নেতা-নেত্রীরা।

ঈষৎ অলক্ষ্যেই অনেকটা দূর গড়িয়ে গিয়েছে জল। আকাশজোড়া গেরুয়া ঝড় ছিল প্রায় আসমুদ্রহিমাচল। কিন্তু এ ভূমি তো একরঙা নয়। তাই বিপন্ন বোধ করেছে অন্যান্য রং। অন্তঃসলিলা প্রবাহের মতো এক আধারে গিয়ে মিশতে চেয়েছে নানা রঙের ধারা। ফলাফল ১৩০ কোটির চোখের সামনে— কর্নাটকের আকাশ জুড়ে সুবিশাল রাজনৈতিক বর্নালী, গোটা ভারতের আকাশে যে বর্নালীর বিচ্ছুরণ চাইছে অ-বিজেপি শিবির।

Advertisement

কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন এইচ ডি কুমারস্বামী। নির্বাচনের ফলাফল বলেছে, একক বৃহত্তম দল বিজেপি। কিন্তু ফল এও বলেছে যে, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ নয় বিজেপি। দিল্লির মসনদে গৈরিক ধ্বজা উড্ডীন হওয়ার পর থেকে এ যাবৎ একাধিক রাজ্যের নির্বাচনে এই রকমই ত্রিশঙ্কু ফলাফল এসেছে। কোথাও বিজেপি গরিষ্ঠ হয়েছে, কোথাও লঘিষ্ঠ হয়েছে। কিন্তু সেই রাজ্যগুলির কোনওটিতেই বিজেপি বিরোধী আসনে বসেনি, সর্বত্র ক্ষমতাসীন হয়েছে। প্রথম ধাক্কাটা কর্নাটকেই লাগল। ২০১৪-র পরে এই প্রথম ত্রিধারায় বিন্যস্ত কোনও বিধানসভা অ-বিজেপি বা অ-এনডিএ মুখ্যমন্ত্রীকে নির্বাচিত করল। অতএব অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই সব আলোকরশ্মি এইচ ডি কুমারস্বামীর মুখে পড়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হল না। কুমারস্বামী আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠলেন না, এমন নয়। কিন্তু তার চেয়েও চড়া আলো পড়ল এক প্রশস্ত পঙ্‌ক্তির উপরে। যাবতীয় মতবিরোধ, অনৈক্য, নীতিগত ফারাক, আদর্শগত দূরত্ব সরিয়ে রেখে যে পঙ্‌ক্তিকে নক্ষত্র সমাবেশের রূপ দিলেন অ-বিজেপি রাজনীতির রথী-মহারথীরা।

কর্নাটকের রাজনীতি এক নতুন মোড়ে হাজির হল। কর্নাটকের হাত ধরে ভারতের রাজনীতিও এক উল্লেখযোগ্য সন্ধিক্ষণের সাক্ষী হল। এ সন্ধিক্ষণ অভূতপূর্ব নয়, আগেও এমন বিরোধী ঐক্য দেখা গিয়েছে। অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা ইন্দিরার বিরুদ্ধেও ভারতজোড়া বিরোধী ঐক্য গড়ে উঠেছিল। তাই ভারত বেনজির কোনও দৃশ্য দেখছে, এ কথা বলা যাবে না। কিন্তু এ বারের সন্ধি চরিত্রে আলাদা। জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বাধীন সেই সন্ধি ছিল কংগ্রেস বিরোধী। আর এ বারের সন্ধি বিজেপি বিরোধী এবং মূলত সেই কংগ্রেসেরই নেতৃত্বে। জাতীয় রাজনীতি বেশ নতুন এক প্রেক্ষাপটে হাজির হয়ে গেল, এ কথা বলাই যায়।

Advertisement

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

এক দিনে তৈরি হয়নি এই প্রেক্ষাপট। দেশের নানা প্রান্ত থেকেই বিজেপি বিরোধিতার স্বর শোনা যাচ্ছিল বেশ কিছু দিন ধরে। দেশের প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে কংগ্রেস ময়দানে তো ছিলই। কোনও প্রান্তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরব হচ্ছিলেন। কোথাও অখিলেশ-মায়াবতী জোট বাঁধছিলেন। কোনও খণ্ডে চন্দ্রবাবু নায়ডু অস্ত্রে শান দিচ্ছিলেন। কোথাও আবার বামেরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। গোটা বিরোধী শিবিরকে এক ছাতার তলায় আনার প্রস্তাব ভেসে উঠছিল মাঝেমধ্যেই, ইস্যুভিত্তিক বৈঠকও হচ্ছিল। কিন্তু কোনও সংহত রূপ পাচ্ছিল না বিরোধী ঐক্যের প্রস্তাবনা। কর্নাটকের মসনদ থেকে বিজেপি-কে দূরে রাখতে জেডি(এস)-এর দিকে কংগ্রেস হাত বাড়াতেই লহমায় রূপ পেয়ে গেল বিরোধিতার সেই প্রতিমূর্তিটা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর সীতারাম ইয়েচুরি কাছাকাছি চলে এলেন, অখিলেশ-মায়াবতীকে উত্তরপ্রদেশের বাইরেও একসঙ্গে দেখা গেল, চন্দ্রবাবু নায়ডু আর রাহুল গাঁধী এক ফ্রেমে ধরা দিলেন, সনিয়া গাঁধী আর দেবগৌড়া এক মঞ্চে হাজির হলেন।

আরও পড়ুন: শপথ নিলেন কুমারস্বামী, সনিয়া-রাহুল-মমতা-চন্দ্রদের নিয়ে অনুষ্ঠান যেন চাঁদের হাট

অধিকাংশ বিজেপি বিরোধী শক্তিকে এক মঞ্চে দেখে গেল ঠিকই, কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ঐক্যের বুনট খুব মজবুত। রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদ বা অন্য কোনও কারণ অধিকাংশ বিরোধী দলকে এক মঞ্চে আনল। কিন্তু, কুমারস্বামীর শপথ মঞ্চে এক পঙ্‌ক্তিতে দাঁড়ালেন যাঁরা, স্বার্থের সংঘাত তাঁদের নিজেদের মধ্যেও রয়েছে। বিজেপিকে ঠেকাতে সিপিএম আর তৃণমূল জোট বেঁধে বা পরস্পরের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে লড়বে, এমন কোনও সম্ভাবনা এখনও অন্তত দেখা যাচ্ছে না। মোদী-বিরোধী জোটের নেতৃত্বে রাহুল গাঁধীকেই চাইছেন লালুপ্রসাদ, দেবগৌড়া, শরদ পাওয়াররা। কিন্তু, কংগ্রেসের নেতৃত্বে জোট কিছুতেই মানতে রাজি নন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাহুল-সনিয়ার সঙ্গ এড়াতে চান চন্দ্রশেখর রাও-ও। অতএব, ঠাসবুনটে পৌঁছতে এখনও অনেকটা পথ যেতে হবে বিরোধী শিবিরকে। যুদ্ধ জয় হয়ে গিয়েছে, এখনই এমনটা ভেবে নেওয়ার সময় আসেনি।

আরও পড়ুন: বিরোধী শক্তির শপথ

অন্য দিকে, নিশ্চিন্ত থাকার মতো পরিস্থিতি কিন্তু আর নেই বিজেপির। বেঙ্গালুরুর মঞ্চে ঐক্যের ছবি তুলে ধরার চেষ্টা হলেও আসলে বিরোধীরা এখনও ছত্রখান, এমনটা ভেবে সুখনিদ্রায় অভিভূত থাকার অবকাশ নরেন্দ্র মোদীর নেই। যতজন বিরোধী নেতাকে কুমারস্বামীর শপথ মঞ্চে দেখা গিয়েছে, তাঁরা সবাই পরস্পরের সঙ্গে হাত মেলাতে না পারলেও, অধিকাংশই পারবেন। তাতেই কিন্তু থেমে যেতে পারে গেরুয়া বিজয়রথ। আসন সংখ্যার বিচারে বিজেপি প্রতিপক্ষের চেয়ে অনেক এগিয়ে। কিন্তু, প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হিসেব বলছে, যেখানে যেখানে একত্র হবে বিরোধী ভোট, সেখানেই অশনি সঙ্কেত রয়েছে বিজেপির জন্য। বিহারে লালু-নীতীশ যখন একত্র ছিলেন, তখন এর প্রমাণ মিলেছে। গোরক্ষপুর ও ফুলপুরে অখিলেশ-মায়াবতী যখন হাত মিলেয়েছেন, তখনও সে কথা প্রমাণিত হয়েছে। অতএব, ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিরোধী শিবির থেকে আসা চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হলে নিজেদের ভোট অনেকখানি বাড়িয়ে নিতে হবে বিজেপিকে। এ ছাড়া আর কোনও পথ নেই।

দিনের শেষে কোথায় পৌঁছল হিসেবটা তা হলে? কর্নাটক থেকে ভেসে আসা বাতাস বলছে, উত্তপ্ত হবে রাজনীতি, তীব্র হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী পদে বসা ইস্তক এক তরফা হয়ে গিয়েছিল লড়াইটা। কর্নাটক সেই প্রবণতা বদলে দিল। দিগন্তে বৃত্তমান সাধারণ নির্বাচন-২০১৯। দিগন্তে বৃত্তমান সুবিশাল অ-বিজেপি সমীকরণ এবং তার মুখোমুখি অবস্থানে বৃত্তমান প্রায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা মোদীর মুখোচ্ছবি। সিদ্ধান্তের ভার বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের হাতে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন