দূরেই থাক না ওদের পৃথিবী

তিনি পৃথিবী-বিচ্ছিন্নদের কাছে ঈশ্বরকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তাদের আপন করতে চেয়েছিলেন। কিছু উপহারও দিতে চেয়েছিলেন ভালবাসার চিহ্নস্বরূপ।

Advertisement

পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

এই সভ্যতা বড় ভয়ানক। সে আগে বন্ধুত্ব পাতাবে। তার পর আব্রু ছিঁড়ে ভিতরে ঢুকে সবটুকুর দখল নেবে।

জন অ্যালেন চাউ-এর মৃত্যু বড় মর্মান্তিক, সন্দেহ নেই। তিনি পৃথিবী-বিচ্ছিন্নদের কাছে ঈশ্বরকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তাদের আপন করতে চেয়েছিলেন। কিছু উপহারও দিতে চেয়েছিলেন ভালবাসার চিহ্নস্বরূপ। কিন্তু আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপের বাসিন্দা সেন্টিনেলিজ় জনজাতি তাঁর সেই ভাষা বোঝেনি। তাদের তিরেই জনের মৃত্যু হয়েছে বলে খবর। মৃতদেহটি কোথায়, সে সন্ধানও মেলেনি।

Advertisement

দ্বীপে নামার আগে তাঁর রেখে যাওয়া নোটগুলো প্রমাণ, আন্দামান ও এখানকার জনজাতি সম্বন্ধে জন কিছু পড়াশোনা করেছিলেন। জানতেন, কয়েক হাজার বছর ধরে সেন্টিনেলিজ়রা বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে সমস্ত সংস্রব ত্যাগ করেই বেঁচে আছে। তারা সেই পৃথিবীর সঙ্গে কোনও সংযোগ চায় না। কিন্তু এই ইতিহাসকে জন গুরুত্ব দেননি। হয়তো, কয়েক হাজার বছরের প্রায় অ-পরিবর্তনীয় ইতিহাসকে তিনি পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। যেমনটা আর পাঁচ জন ‘সভ্য’ মানুষ করতে চায়। সমাজের চোখে যারা ‘অ-সভ্য’, তাদের মধ্যে নিজেদের সভ্যতার আলোটুকু পৌঁছে দিতে, তাদের ‘এনলাইটেন’ করতে চায়। জন হয়তো সেই আলোই নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। এই ভাবনায় আপাতদৃষ্টিতে ভুল নেই। সত্যিই তো, সরকারি আইনকানুনের যারা তোয়াক্কা করে না, অন্য লোক দেখলেই বিষমাখা তির ছোড়ে এবং দৈবাৎ কেউ এসে পড়লে খুন করে মৃতদেহ হয় পুঁতে, নয় টাঙিয়ে রেখে সভ্যতাকে ভয় দেখাতে চায়, সভ্য হওয়া তাদের জন্য জরুরি বইকি!

অনেকটা এমন ভাবনা থেকেই সেন্টিনেলিজ়দের সঙ্গে সখ্য জমানো, আপদে-বিপদে পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা সরকারি স্তর থেকেও করা হয়েছিল। কিন্তু সাড়া মেলেনি। বরং উপহারের বদলে ফেরত এসেছে এক রাশ বিরূপতা। তবে ষাটের দশক থেকে অ্যানথ্রপলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার তরফ থেকে করা উদ্যোগগুলোয় কিছু অন্য সুর ধরা পড়ে। নৃতাত্ত্বিক টি এন পণ্ডিত ছিলেন সেই সব সফরে, দ্বীপে পা-ও রাখেন কিছু ক্ষণের জন্য। বাসিন্দারা সামনে আসেনি, কিন্তু আক্রমণও করেনি। পরবর্তী কালে উপহার হিসেবে লোহার রড, বাসনপত্র, নারকেল তারা গ্রহণও করে। নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় আরও এক ধাপ এগিয়ে সেন্টিনেলিজ়রা সরাসরি তাঁদের হাত থেকে নারকেল নিয়েছিল। নারকেল যে তাদের ভারী পছন্দের!

Advertisement

কিন্তু, বাইরের পৃথিবীর ছোঁয়া বলতে ওইটুকুই। যোগাযোগ এগোয়নি। বরং দ্বীপের কাছাকাছি গেলে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, আগন্তুকরা অবাঞ্ছিত। এখনও কেউ জানে না, সেন্টিনেলিজ়রা কী ভাবে বেঁচে থাকে, কোন ভাষায় কথা বলে, তাদের সমাজ কী, চিকিৎসাপদ্ধতি কেমন। তথ্যের সঙ্গে অনেকটা অনুমান আর বিচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতা মিলিয়েমিশিয়ে এক ভাসা ভাসা ধারণা গড়ে তোলা হয়েছে। গোটা দ্বীপে বাসিন্দাদের ঠিক সংখ্যা জানা যায়নি, তবে অনুমান, তা পঞ্চাশ-ষাট জনের বেশি নয়। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকেই সরকারি কর্তারা সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা বন্ধ করে বাসিন্দাদের সঙ্গে কয়েক দফা সংঘর্ষের পর। নিয়মিত নজরদারি চলে, কিন্তু দ্বীপের পাঁচ কিলোমিটার জলসীমার মধ্যে প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়।

এত দিন সেই অজানা দ্বীপের না-জানা কাহিনি নিয়েই বাকি বিশ্বকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যে শান্তিতে ছিল সেন্টিনেলিজ়রাও। যা পারেনি আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের অন্য তিনটি আদিম জনগোষ্ঠী। গ্রেট আন্দামানিজ় আর ওঙ্গিরা নিজেদের পরিচয়, ভাষা প্রায় হারিয়ে, স্বাধীন সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে সরকারের দেওয়া সাহায্যের ওপর নির্ভর করে টিমটিম করে টিকে আছে। এক দিকে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাহীন মানুষগুলোকে উজাড় করেছে বাইরের পৃথিবীর ভয়ঙ্কর জীবাণু। অন্য দিকে, তাদের ধাত্রীভূমি চিরহরিৎ অরণ্যকে তছনছ করেছে মানুষের লোভ। সবই সভ্যতার দান।

জারোয়ারা অবশ্য এখনও স্বাধীন। নিজেদের শিকারি-সংগ্রাহক পরিচয় ঝেড়ে ফেলেনি তারা। কিন্তু বাইরের পৃথিবীর ছোঁয়াকে স্বীকার করে সভ্য হওয়ার রাস্তায় এগিয়েও চলছে। তাদের বাসস্থানের বুক চিরে হাইওয়ে বানানো হয়েছে আদালতের আপত্তি অগ্রাহ্য করেই। এখন আন্দামান পর্যটনের এক বড় আকর্ষণ জারোয়া সাফারি। তাদের দিকে খাবার বাড়িয়ে, কাপড় ছুড়ে, আদিম দেহভঙ্গিমা দেখে আমোদ লোটে সভ্য পৃথিবীর মানুষরা। সম্প্রতি পুলিশকর্মী ও এক দল পর্যটকের সামনে জারোয়া মেয়ের নাচের ভিডিয়ো ভাইরাল হয়। সমালোচনাও হয়। কিন্তু সভ্য হওয়ার আনুষঙ্গিক বিষয় বলেই বোধ হয় জল বেশি দূর গড়ায়নি।

একমাত্র মাথা নোয়ায়নি সেন্টিনেলিজ়রা। কিন্তু আর কত দিন? জন নিজে পারেননি, কিন্তু তাঁর মৃত্যু বিশ্বের চোখে ফের জাগিয়ে তুলেছে সেন্টিনেল দ্বীপের নামটিকে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সামনে তির-ধনুকের প্রতিরোধ আর কতটুকুই বা! ভারত সরকারের তরফ থেকেই তো দ্বীপটিকে দেওয়া সরকারি সুরক্ষাকবচ খানিক আলগা করা হয়েছে কয়েক মাস আগে। হয়তো এটাই শেষের শুরু।

এই সভ্যতা বড় ভয়ানক। সে আগে বন্ধুত্ব পাতাবে। তার পর আব্রু ছিঁড়ে ভিতরে ঢুকে সবটুকুর দখল নেবে। দ্বীপের চিরহরিৎ অরণ্য সাফ করে রাস্তা, মোবাইল টাওয়ার, জমজমাট পর্যটন কেন্দ্র, শপিং মল। আর সেই আদিম, ‘হিংস্র’ জনজাতির কী হবে? ভয়াল সুনামি তাদের ঘরছাড়া করতে পারেনি, কিন্তু আধুনিক মানুষ নিশ্চয়ই পারবে। তারা হয় রোগে উজাড় হবে, নয়তো প্রতিনিয়ত বদলে যাওয়া পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে খাওয়াতে এক সময় মিউজ়িয়ামের শো-কেসে ঠাঁই নিয়ে উন্নততর মানুষদের কৌতূহল মেটাবে। জনা পঞ্চাশ মানুষের সম্পূর্ণ উবে যেতেই বা কত দিন লাগে?

বিশেষজ্ঞদের আবেদন, ছেড়ে দেওয়া হোক সেন্টিনেলিজ়দের। তাদের মতো করে। হিংস্র তো নয় তারা, কেবল নিজের সম্পদটুকুকে বুক দিয়ে আগলে রাখতে চায়। কিন্তু সে কথা শুনবে কে? সভ্যতা নিজেই যে বধির!

ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন