ফাইল চিত্র।
ফ্যাসিবাদ তবে কাহাকে বলে? দেশ জুড়িয়া বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর মেধাজীবী, সমাজকর্মীদের গ্রেফতার করিয়া আনাকে তবে কী নামে ডাকিবেন দেশবাসী? অথবা, ঘোষিত ভাবে নরেন্দ্র মোদীর বিরোধী আইপিএস অফিসারকে গ্রেফতার করা? অথবা, কোনও এক তরুণী প্রকাশ্যে এই সরকারকে ‘ফ্যাসিবাদী’ বলিয়াছে, মাত্র এই কারণে তাহাকে গ্রেফতার করিয়া লইয়া গেলেও কি সরকারকে ফ্যাসিবাদী বলা চলিবে না? তামিলনাড়ুর লোয়া সোফিয়া-র সহিত কোনও রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সম্পর্ক ছিল বলিয়া এখনও জানা যায় নাই। তিনি বিদেশে গবেষণারত এক ভারতীয় নাগরিক। শিক্ষিত, তরুণী। অতএব, সরকারের বিরুদ্ধে তাঁহার ক্ষোভের উৎসটি কী, তাহা বিচার করাই বিধেয় ছিল। বোঝা উচিত ছিল, এক জন সাধারণ নাগরিকের চক্ষে কেন এই সরকার ফ্যাসিবাদী ঠেকিতেছে। তাহার পরিবর্তে বিজেপি নেতা সোফিয়ার বিরুদ্ধে পুলিশে নালিশ ঠুকিলেন। পুলিশ তাহাকে তিনটি ধারায় গ্রেফতার করিল। সরকারের কঠোরতম সমালোচনা করাও যে নাগরিকের বাক্স্বাধীনতার অন্তর্গত— বস্তুত, গোলাপ ফুলের সমালোচনা করিবার জন্য যে বাক্স্বাধীনতা প্রয়োজন হয় না, সরকারের সমালোচনা করিবার জন্যই তাহা দরকার— এই কথাটি নেতা যেমন ভুলিলেন, প্রশাসনও তেমনই ভুলিল। এই বিস্মৃতিই ফ্যাসিবাদের চরিত্রলক্ষণ। যে সময়ে প্রশাসন মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করিতে থাকে, বিরুদ্ধ স্বর শুনিলেই তাহার কণ্ঠরোধ করিতে ঝাঁপাইয়া পড়ে, যখন শাসককেই রাষ্ট্র হিসাবে দেখিবার ও দেখাইবার চেষ্টা হইতে থাকে এবং শাসকের বিরোধিতাকে রাষ্ট্রবিরোধিতার তকমা দেওয়া হয়, সেই সময়টিকে ফ্যাসিবাদ ভিন্ন আর কোন অভিধা দেওয়া যাইতে পারে?
কথাটি দিল্লির শাসকদের সম্ভবত পছন্দ হইবে না। তাঁহারা নাগপুরের আদর্শে বিশ্বাসী। সেই আদর্শে শৃঙ্খলার গুরুত্ব প্রচুর, এবং শৃঙ্খলার অর্থ প্রশ্নহীন আনুগত্য। ফলে, যে নাগরিকরা প্রশ্ন করিতেছেন, নরেন্দ্র মোদীর শাসনভঙ্গিতে নিজেদের আপত্তি ব্যক্ত করিতেছেন, নাগপুরের দর্শন তাঁহাদের ‘অ-স্বাভাবিক’ হিসাবেই দেখিবে। স্বাভাবিকের সহিত অ-স্বাভাবিকের সংলাপ নাগপুরের পাঠশালার শিক্ষাক্রমে নাই। মতাদর্শগত বা পদ্ধতিগত বিরোধ মানেই যে শত্রুতা নহে, এবং কোনও নাগরিক যত ক্ষণ অবধি না রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করিতেছে, তত ক্ষণ অবধি তাহাকে শত্রু জ্ঞান করিবার অধিকার সরকারের থাকিতে পারে না, এই কথাটি তাঁহারা নাগপুর হইতে শিখিয়া আসেন নাই। ফলে, কানহাইয়া কুমার হইতে সঞ্জীব ভট্ট, সুধা ভরদ্বাজ হইতে লোয়া সোফিয়া, প্রত্যেকেই এখন রাষ্ট্রের ‘শত্রু’ হিসাবে চিহ্নিত। এবং, রাষ্ট্র তাঁহাদের দমন করিতেছে, শত্রুকে দমন করা ন্যায্য বলিয়াই। সরকারের বিরোধী মাত্রেই রাষ্ট্রের শত্রু, এই নির্মাণ চরিত্রগত ভাবে ফ্যাসিবাদী। গণতন্ত্রের সহিত তাহার মূল ফারাক এখানেই। এবং, ফ্যাসিবাদ কখনও নাগরিকদের একটি অংশের সক্রিয় সমর্থন ভিন্ন প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে না। শত্রু চিহ্নিত করিবার এই প্রক্রিয়ায় নাগরিক সমাজের প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকে। ভারতীয়দের একাংশ এই কাজে অতি উদগ্রীব। অতঃপর প্রশ্ন, এই আগ্রাসন ঠেকাইবার কাজে গণতান্ত্রিক উদারবাদী নাগরিক সমাজ কতখানি সক্রিয় ভূমিকা লইবে? প্রতিবাদে যত বার প্রয়োজন, পথে নামিতে প্রস্তুত তো ভারতের গণতান্ত্রিক জনগোষ্ঠী?