International Women's Day

ওরা তোমার লোক? অ মা, আমরা কার লোক তবে?

আপনি কি জানেন, ইটভাটায় এক একটা মেয়ে আপনার শ্রম দফতরের বেঁধে দেওয়া ‘মিনিমাম ওয়েজ’-এর চেয়ে দিনে একশো থেকে একশো কুড়ি টাকা কম পায়?

Advertisement

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২০ ০৩:৩৪
Share:

এই টুইটার হ্যান্ডল লইয়া কী করিব? দেশের মেয়েরা মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে বসেছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ভোট দিয়েছেন মেয়েদের, নারী দিবসের সারপ্রাইজ গিফট। একটা গোটা দিন নমো-র সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে পারবে মেয়েরা। সারা দেশ দেখবে, প্রধানমন্ত্রীর মঞ্চে দাঁড়িয়ে বার্তা দিচ্ছে খেঁদির মা, বুঁচির পিসি, আফসানার খালা, সোনামণির দাদি। মানে, তারা যদি সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে পারে, তবেই না। আর যদি মুখ বেঁকিয়ে, চোখ ঘুরিয়ে, ঝঙ্কার দিয়ে বলে, ‘আ মরণ, মিনসের ঢং দেখো না! সেই কবে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পনেরো লক্ষ টাকা দেবে বলেছিল। আজ অবধি পাসবুকে তার একটি পয়সা উঠল না, এখন ফেসবুক দেখাচ্ছে। ঝ্যাঁটা মার উপহারে,’ তা হলেই চিত্তির। সত্যি, গরিব মেয়েগুলোর যদি কোনও কাণ্ডজ্ঞান থাকে!

Advertisement

আচ্ছা, তার চাইতে এই সব আঁশের চুবড়ি, সব্জির ঝাঁকা, কয়লা কুড়ানি, পাথর ভাঙানিদের হয়ে একটা টুইট করে দেওয়া যাক। হ্যাশট্যাগ পাঁচ রুপাইয়া বারা আনা।

মানে, বড় বড় কথা রাখ, আমার পাওনাটুকু ছাড়ো বাছা। যখন ইটভাটায় কাজ করি, কাঁচা ইট তৈরি কিংবা পোড়া ইট বওয়ার জন্য যে ন্যূনতম মজুরি লেখা রয়েছে সরকারি নোটিসে, তাই যেন পাই। যখন বিড়ি বাঁধতে বসি, এক হাজার বিড়ি পিছু যে টাকা পাওয়ার কথা, সেটুকু যেন তুলে দেওয়া হয় আমার শিরা-ওঠা হাতে। রাজমিস্ত্রির জোগাড় দেওয়ার কাজ, ব্যাগ কারখানায় চামড়া কাটার, হোসিয়ারি কলে গেঞ্জির ফোঁড় দেওয়া, যা যা কাজ দল বেঁধে করে মেয়েরা, তার জন্য সব মেয়েকে সরকারি রেটে যেন টাকা দেওয়া হয়। না, তামাক টেনে টেনে শ্বাসকষ্ট, বিড়ির ডালা ধরে বসে বসে পিঠ বেঁকে যাওয়া, এ সবের জন্য বাড়তি টাকা চাইছি না। ইট বয়ে বয়ে ঘাড়ে-পিঠে-কোমরে অসহ্য ব্যথা, ফটো তুলতে ডাক্তার আড়াইশো টাকা চায়, সে কথাও তুলছি না। বলছি না গেঞ্জি কারখানার মাথা ঘুরিয়ে-দেওয়া গরমের কথা, যার জন্য দ্যাখ না দ্যা‌খ নানা রোগে মরে যাচ্ছে চার-পাঁচ বছর একটানা কাজ-করা মেয়েরা, পঁয়ত্রিশ না পেরোতে। সবই বুঝি, কিন্তু বুঝে আর কী হবে? মরতে মরতেও মেয়েদের উঠে গিয়ে কাজ করতে হবে।

Advertisement

আর হতাশার জ্বলুনি, সে-ও কি শুধু তোমার কথায় নিভবে? মা হয়ে যখন দেখি, সন্তান পাতার মধ্যে ধুলো পাকিয়ে বিড়ি বাঁধা শিখছে, কচি হাতে উল্টে দিচ্ছে কাঁচা ইট, শীতের ভোরে ইস্কুলে-পড়া মেয়ে মস্ত হাঁড়ি হাতে গলা জলে বাগদার মিন ধরছে, আর এই ভাবে দারিদ্র আর অপমান চারিয়ে যাচ্ছে এক প্রজন্ম থেকে আর একটায়, তখন তার মনে কী উথালপাথাল হয়! সে কথাও তুলছি না মাননীয় স্যর। কেবল বলছি, আপনারই শ্রম দফতর যে কাজের জন্য যে টাকা পাওয়া কথা বলে, তা যদি একটু দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন স্যর।

আরও পড়ুন: নারী-পুরুষ এবং বিভাজনের বোধ রোজ ভাঙছে-গড়ছে বলিউড

আপনি কি জানেন, ইটভাটায় এক একটা মেয়ে আপনার শ্রম দফতরের বেঁধে দেওয়া ‘মিনিমাম ওয়েজ’-এর চেয়ে দিনে একশো থেকে একশো কুড়ি টাকা কম পায়? হাজার বিড়ি বেঁধে দিলে যা পাওয়ার কথা, পায় তার চেয়ে তেষট্টি থেকে সত্তর টাকা কম? তা আপনি দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, এমন লোসকানটা– থুড়ি, লোকসানটা একটু হিসেব করে দেখুন দেখি। এই বাজারে, এত লস করলে একটা মেয়ে সংসার চালাতে পারে? পারতেন আপনার মা? না না, ও সব শ্রমিক কার্ড, সামাজিক সুরক্ষা কার্ড, বিড়ি ওয়ার্কার কার্ড আমাদের নেই। আমরা তো ঠিকেমজুর স্যর। আমরা ওয়ার্কার নই। আপনার আইন তো শুনছি আরও বেশি করে কাজ ঠেলে দিচ্ছে ঠিকাদারের হাতে। পাকা চাকরি নাকি আর থাকবেই না।

আরও পড়ুন: আমার ভেতরের নারীকে গড়া আজও শেষ হয়নি

বলে আর কী হবে স্যর। গরিব মেয়ের কষ্ট আপনি বুঝবেন, এমন ভরসা হয় না। এই তো অঙ্গনওয়াড়ি আর আশাদিদিদের দেখছি। গোলাপি শাড়ি, বেগুনি শাড়ি পরে, রেজিস্টার বগলে, দিনে রাতে কী ছোটাছুটিই না করে। আর ওই মিড ডে মিলের দিদিরা, ওরে বাপ রে। একশো-দেড়শো বাচ্চার রান্না করে, তার কাঠ আনো রে, জল তোলো রে, উনুন ধরাও, পরিবেশন, খাওয়ার পর ধোয়া-পাকলা, রোজ রোজ যজ্ঞিবাড়ির কাজ। তার পর হাতে যা দাও তোমরা, দেখে বাপু দুঃখে হাসি আসে। এর নাম নাকি সর্বশিক্ষে? এই শিক্ষে নিয়ে যারা বড় হচ্ছে, তারা মেয়েদের কাজের দাম দেবে? তুমিই বলো না গো।

সে দিন ইস্কুল কুকদের মিছিল হল। শুনলাম, ওরা নাকি একুশ হাজার টাকা বেতন চায়। শুনে আমরা আধবুড়িরা চোকখু কপালে তুলে গালে হাত দিতে কুক মেয়েরা বলল, ‘অমন করছ কেন মাসি? এই দেখ না, সরকার মাটি কাটলে যা দেয়, সেই দরে টাকা দিলেও সারা মাসে অমনি মাইনে হবে।’ হিসেবও বুঝিয়ে দিল। ওদের কয়েকটা ইস্কুল পাশ দিয়েছে তো, বেশ চৌকস। আহা, ভাল মাইনে পেয়ে বেঁচে থাক। মাটি কাটার কাজ আমরাও করেছি, তা বলে রান্নার সঙ্গে তার তুলনা? একটা মাছের ঝোল রেঁধে দেখাক না ওই কোদাল-গাঁইতি মারা মদ্দগুলো। অ, তোমার তো আবার নিরামিষ্যি। তা ধোঁকার ডালনাই রাঁধতে বল ওদের। সে রান্না বাড়ির মিনসের পাতে দিলে কুরুক্ষেত্তর বেঁধে যাবে। আচ্ছা, না হয় আমিই তোমাকে ধোঁকা রেঁধে দেব, তুমি বাপু ওই মেয়েগুলোকে এমন করে ধোঁকা দিও না। দেড়শো ছেলের ভাত রেঁধে মাসে দেড় হাজার টাকা, এ কি কোনও রেট হল? তোমার বাড়ির কাজের মাসি তোমার একার জন্য রেঁধে এমন টাকা পায়?

দেখো, তোমার কাছে ফ্রি গিফট চাইনি। বকশিস চাইনি। বাড়াতে বলিনি টাকা। কেবল আমাদের যে টাকাটা মেরে দেয় ইটভাটার মালিক, গেঞ্জিকলের মালিক, বিড়ি কারখানার মালিক, ওই মজুরির টাকাটা আমাদের এনে দাও তুমি। কী বলছ, ওরা তোমার লোক? অ মা, আমরা কার লোক তবে?

ছবি: শাটারস্টক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন