Advertisement
E-Paper

আমার ভেতরের নারীকে গড়া আজও শেষ হয়নি

এক দিনে কেউ সম্পূর্ণ হয় না। তিলে তিলে জীবনের সমস্ত সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত নিয়ে তবে গড়ে ওঠে এক সম্পূর্ণ নারী।

অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২০ ০১:০০
গড়া এখনও শেষ হয়নি। এখনও মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে বুকের ভেতর ছেনি-হাতুড়ি ঠোকার ঠকঠক শব্দ শুনি। তবে কি গড়া শেষ হবে না কোনও দিন?

গড়া এখনও শেষ হয়নি। এখনও মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে বুকের ভেতর ছেনি-হাতুড়ি ঠোকার ঠকঠক শব্দ শুনি। তবে কি গড়া শেষ হবে না কোনও দিন?

সংসার যার মাথা নোয়াতে পারেনি, পুরুষ যার তল পায়নি, আমি সেই বিশ্বের বিস্ময় আশ্চর্যময়ী নারী।

না, এখনও সম্পূর্ণ হতে পারিনি। এক দিনে কেউ সম্পূর্ণ হয় না। তিলে তিলে জীবনের সমস্ত সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত নিয়ে তবে গড়ে ওঠে এক সম্পূর্ণ নারী।

আমার বুকের চাতালে বসে থাকে এক দক্ষ কারিগর। সে অবিরত ভেঙে গড়ে আমার ভেতর তৈরি করে চলেছে এক আশ্চর্য নারী। ছোটবেলায় কবে যেন আমাকে দেখে পিসিদিদা বলেছিল, ‘ওমা, কি শান্ত হয়ে গেছিস!’

শৈশবের দুরন্ত মেয়ে কৈশোরে শান্ত নদী। এ ভাবেই কারিগরের ভাঙা-গড়া শিল্পের ভেতর কেবলই বদলে যাচ্ছি আমি। হ্যাঁ, আমি নারী ব’লে গর্বিত, তৃপ্ত। কৃতজ্ঞ নারীজন্মের কাছে।

শৈশবের দুরন্ত মেয়ে কৈশোরে শান্ত নদী।

জীবনে চলার পথে চলতে চলতে যা কিছু কুড়িয়ে পাই, সব তুলে দিই সেই কারিগরের হাতে। এই নাও... ধরো... গড়ে তোলো আমার ভেতর নারী। খেলতে খেলতে আছড়ে পড়ে হাঁটু কেটেছে, ধুলো ঢুকেছে জিভে। বকুনির ভয়ে হাঁটুর সেই অসহ্য যন্ত্রণা ঝুল ফ্রকের নীচে লুকিয়ে রেখেছিলাম অনেক ক্ষণ। আমার সেই সহ্য, সেই ধুলোস্বাদ, সেই পতনের শব্দ বুকের দরজা খুলে তুলে দিয়েছি কারিগরের হাতে। বোধহয় তখন ক্লাস টু। ভাল করে ‘ড়’ বলতে পারি না। ঠিকমতো হাত যায় না হারমোনিয়ামের রিডে। শুরু হয়ে গেল গানের ক্লাস, নাচের ক্লাস, আবৃত্তির ক্লাস। বিকেলে সাঁতার। তার সঙ্গে পড়াশোনা তো আছেই। আমার খেলার মাঠ চলে গেল আড়ির পাতায়।

আরও পড়ুন: আগল ভেঙে বেরিয়ে এসে চমকে দিলেন শাহিন বাগের মুসলিম মহিলারা

কাঁদিনি, হাত-পা ছুঁড়িনি, চিৎকার করিনি। এগুলো যে করতে হয় জানিই না। শুধু আমার সেই আনুগত্য, সেই মেনে নেওয়া, সেই সাধনা, একাগ্ৰতা, অধ্যবসায় নিজের অজান্তেই তুলে দিয়েছি কারিগরের হাতে। তার পর স্কুল-কলেজ, রেডিও, টিভি, ডোভার লেন কম্পিটিশন, ফাংশন, মাইক, হাততালি ছুঁতে ছুঁতে এগিয়ে চলেছি। ‘সানন্দা মিস তিলোত্তমা’র মুকুট উঠলো আমার মাথায়। পরিচালক প্রভাত রায় ডেকে পাঠালেন। তার পর থেকে কত পরিচালক, চিত্রনাট্য, লাইট, সাউন্ড, ক্যামেরার ভেতর দিয়ে আজও হেঁটে যাচ্ছি। এরই মধ্যে প্রেম। বিয়ে হল। মিশুক এল কোলে। আমি প্রেমিক, আমি স্ত্রী, আমি মা, আমি নারী। শখ করে রান্না করি। পুজো করি। ছেলের দেখাশোনা করি, সকাল ৮টায় কলটাইম, দৌড়ে যাই। কাজের ফাঁকফোকর গলে উড়ে যাই দিল্লিতে আমার নিজস্ব ব্যবসায়। কাজ আর কাজ, কেবল ছুটে চলা। এই ছুটে চলা পথের দু’পাশ থেকে যত মুখ আর মুখোশ, ঘটনার চৌকো গোল বক্র সরল রেখা, অভিজ্ঞতার টক-ঝাল-মিষ্টি। যত শেখা, যত জানা, যত চেনা, সব তুলে দিচ্ছি ওই কারিগরের ঝোলায়। কারণ ও জুড়ে জুড়ে গেঁথে গেঁথে আমার ভেতর নারীকে সম্পূর্ণ করছে।

গড়া এখনও শেষ হয়নি। এখনও মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে বুকের ভেতর ছেনি-হাতুড়ি ঠোকার ঠকঠক শব্দ শুনি। তবে কি গড়া শেষ হবে না কোনও দিন? হবে। আমার মৃত্যুশয্যার কালো ধোঁয়া নারীর চিবুকে এঁকে দেবে শেষ তিলটি। সে দিন উঠে দাঁড়িয়ে হাত মুছে কারিগর বলবে, এই শেষ হল। এই এত ঐশ্বর্য দিয়ে তৈরি হয় ব’লেই নারী সুন্দর, চিরন্তন, লাস্যময়ী, আশ্চর্য।

গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।

Arpita Pal Arpita Chatterjee International Women's Day অর্পিতা চট্টোপাধ্য়ায়
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy