Digital Revolution

হাজার হাজার ভাসমান দিয়ার মতো আলোয় ভরা সম্ভাবনার নাম ফেসবুক

আশির দশকেও আমেরিকা থেকে ভারতবর্ষে ফোন করাটা আমাদের কাছে ছিল এক একটা পরিকল্পিত প্রকল্প। আজকের দূরভাষ ব্যবস্থার এই নিঃশব্দ বিপ্লব, তাৎক্ষণিক যোগাযোগের এই সঙ্কুচিত জগৎ আমার কাছে ভীষণ এক প্রাপ্তি। লিখছেন বিশ্বজিৎ সেন

Advertisement

বিশ্বজিৎ সেন

শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৩:২৮
Share:

সত্তরের দশকের সেই সব দিনগুলো এখনও বেশ মনে আছে। কলকাতার টেলিফোন ভবনের উল্টো দিকে সিটিও অফিস বলে একটা বাড়ি ছিল যেখান থেকে পয়সা দিয়ে ট্রাঙ্ক কল করা যেত দূরের শহরে। চল্লিশ বছর আগে তখন যাদবপুর বিশবিদ্যালয়ের হস্টেলে থাকি। হস্টেলে একটা ফোন ছিল যা থেকে ‘চিঁ চিঁ’ আওয়াজ ছাড়া কোনও দিন কিছু শুনিনি। আমেরিকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার ডাক এসেছে অথচ অর্থের অভাব। কেউ বলল সিটিও অফিসে গিয়ে ফোন করতে আমেরিকার সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে। যদি কাজ হয়। পাঁচ নম্বর বাসে করে গিয়ে পৌঁছনো গেল সিটিও অফিসে। খাতায় নামধাম ফোন নম্বর লিখে রেখে বসে থাকা। অনন্তকালের অপেক্ষার শেষে আমার ডাক পড়ল। ওই তো শোনা যাচ্ছে আওয়াজ পৃথিবীর অন্য প্রান্তের দেশ আমেরিকা থেকে। রিংটোনটাও কেমন মিষ্টি। ফেরার পথে সেই রাতের শেষ পাঁচ নম্বর বাসের দোতালায় বসে হাওয়া খেতে খেতে আমি তখন অন্য এক ঘোরে আচ্ছন্ন। ভাবছি, পৃথিবীতে যোগাযোগ ব্যবস্থা কোথায় এগিয়ে গেছে। কলকাতা থেকে ফোন করতে পারছি পৃথিবীর অন্য এক প্রান্তে!

Advertisement

আশির দশকেও আমেরিকা থেকে ভারতবর্ষে ফোন করাটা আমাদের কাছে ছিল এক একটা পরিকল্পিত প্রকল্প। ছাত্র অবস্থায় ভার্জিনিয়ার ব্ল্যাক্সবার্গে থাকাকালীন এক দাদাবৌদি মাঝেমাঝে জানাতেন, ‘বিশু, আমাদের কিন্তু আজ ইন্ডিয়াতে ফোন করার ব্যাপার আছে, তাই সকালটায় খুব ব্যস্ত থাকব। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনের বোতাম টিপে যাও। শোঁ শোঁ করে আওয়াজ হচ্ছে, মনে চাঞ্চল্য— লেগে গেল বোধহয় এ বার দূরভাষের যোগাযোগ। কোথায় যেন পড়েছিলাম বাঁকুড়ায় ফোনের টাওয়ার বসানো হয়েছে, যেখানে আন্তর্দেশীয় ফোন কলগুলো গিয়ে পৌঁছয়। ফোনের ওই শোঁ শোঁ আওয়াজ শুনে উত্তেজনায় প্রায় লাফাচ্ছি, বাঁকুড়ায় পৌঁছে গেছে দূরভাষের ডাক তা হলে, আর একটু এগোলেই তো আমার শহর দুর্গাপুর। আজ তা হলে হয়তো কথা বলতে পারব আমার মায়ের সঙ্গে, যিনি প্রতি দিনের মতো সে দিনও বসে আছেন আমার ফোনের অপেক্ষায়।

তাই চল্লিশ বছর পরে আজকের দূরভাষ ব্যবস্থার এই নিঃশব্দ বিপ্লব, তাৎক্ষণিক যোগাযোগের এই সঙ্কুচিত জগৎ আমার কাছে ভীষণ এক প্রাপ্তি। জীবনের বেশির ভাগ সময়ে বিদেশে কাটানো আমাদের মতো অভিবাসীদের কাছে প্রিয়জনের সঙ্গে বন্ধনের শিবরাত্রির সলতে হচ্ছে এই দূরভাষ ব্যবস্থা। দূরদেশিদের কাছে, যাদের অস্তিত্বের নকশায় এখনও আঁকা আছে শিউলি ফুল আর চেতনার হিল্লোলে মিশে আছে গঙ্গার ঢেউ, তাদের কাছে তাৎক্ষণিক যোগাযোগের এই নতুন জগৎ অবিশ্বাস্য এক পুরস্কার। দূরভাষ ব্যবস্থার সেই নীরব বিপ্লবের হাত ধরে গুটিগুটি পায়ে চলে এসেছিল ইন্টারনেট। তার পর দুমদাম করে ড্রাম বাজাতে বাজাতে নাচতে নাচতে আসরে নেমে পড়েছে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলো। বিজ্ঞানের আবিষ্কার আমাদের সামাজিক উত্তরণের নির্দেশিকা লিখে দিয়ে চলেছে চিরকাল ধরে। ফেসবুক সেই রকমই একটা নতুন মেঠো পথ। ফেসবুক আমার ভালই লাগে।

Advertisement

আরও পড়ুন: এই ভয়ানক খেলা সহজে শেষ হবে না, আরও অনেক মূল্য দিতে হবে

প্রথম পর্বের ফেসবুক এনে দিয়েছিল জীবনের হারিয়ে যাওয়া অতীতকে আবার ফিরে পাওয়ার এক মিষ্টি আনন্দ। এক ঝটকায় স্কুলের, কলেজের, ছোটবেলার অনেক বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে গেল। জানতে পারলাম, সময়ের ঝাপটায় তারা কে কেমন ভাবে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। ধীরে ধীরে অতীত, বর্তমান, ভারতবর্ষ, আমেরিকা সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে আমার ফেসবুক জগতে। দুই নৌকা থেকে উঠে এসে সবাই এখন এক ফেসবুক নৌকায় গাদাগাদি। এ দেশের আনন্দে ওই দেশ হেসে ওঠে, অতীত জানিয়ে যায় বর্তমানকে যে সে এখনও বেঁচে আছে। ঠোকাঠুকি যে লাগে না তা নয়। বর্তমানের কোনও অন্যমনস্ক অভিব্যক্তিকে ধাক্কা দিয়ে অতীত কখনও সখনও বলে ওঠে, ‘এটা কিন্তু আস্ফালন’। ভুল শুধরে নিই। অবশ্য অতীতকে খুঁজে পাওয়ার আনন্দটা যেন ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পড়েছে। মন মাঝেমাঝে প্রশ্ন করে, অতীতকে ফিরে পাওয়ার দরকার কি খুব আছে? স্মৃতি আর অতীত কি এক জিনিস? স্মৃতি তো আসলে আমাদের ফেলে আসা জীবনের বাছাই করা কিছু খণ্ডচিত্রের চেতনার রঙে রাঙানো মণিমুক্তা। আর অতীত? সে তো ভাবলেশহীন অপরিশোধিত কঠিন সত্য। দুম করে উঠে এসে অপরিশোধিত অতীত কি ওলটপালট করে দিতে পারে না স্মৃতির স্বপ্নময় জগৎটাকে?

তবু ফেসবুক আমার কাছে ইতিবাচক এক শক্তি। সখ্যতার পরিসংখ্যানে অতীতকে পেরিয়ে বর্তমানের প্রাধান্য এখন বেশি। ফেসবুক আমার কাছে এখন বর্তমানের বারান্দা। বাড়ির ভিতর থেকে জানলার পর্দাটাকে একটু সরিয়ে কাছের মানুষগুলো কেমন আছে সেটা একটু একটু বুঝে নেওয়া। কেউ বেশি ‘লাইক’ দিচ্ছে অন্য এক জনকে— অর্থাৎ বন্ধুত্ব তাদের বেশ দৃঢ় এখন। ছবির পোস্টিং দেখে বুঝতে পারি কোন বাড়ির পার্টিতে আমার ডাক পড়ল না। ফেসবুক পাতায় ঘুরতে ঘুরতে দেখি ছোটবেলার অপরিণত প্রেমের প্রেমিক-প্রেমিকারা কেমন সুন্দর ভাবে তাদের নতুন জীবনে বেঁচে আছে। বয়স্ক জীবনের সঙ্গী ছেলেপুলে নিয়ে তারা এখন তাদের প্রাক্তনদের ফেসবুক বন্ধু। আবার দেখি, পরিচিত ফেসবুক বন্ধুগোষ্ঠীর মধ্যে থেকেও কোনও অপরিণত প্রেমের যুগল নিজেদের মধ্যে ফেসবুক বন্ধুত্ব পাতায়নি। প্রেম সেখানে হয়ত অন্তহীন ফল্গুধারা হয়ে এখনও বেঁচে আছে, বর্তমানের ঝাপটায় অতীত মুছে যায়নি।

ফেসবুক নিয়ে ভাবতে বসলেই আমার মনে পড়ে যায় চন্দ্রাদির কথা। যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাশ করা আর্কিটেক্ট চন্দ্রাদি আমার চেয়ে প্রায় দশ বছরের জ্যেষ্ঠ। কলেজ জীবনে আলাপ ছিল না। তবু এক কলেজে থেকে পাশ করা আৰ্কিটেক্ট। সেই সুবাদে ফেসবুকে যোগাযোগ। এক সময় চন্দ্রাদি হয়ে উঠলেন আমার প্রতি দিনের আড্ডার সঙ্গী। আমার প্রতিটি পোস্টিংয়ে চন্দ্রাদির মমতাময় ‘লাইক’ ছিল অবধারিত। নানান বিষয়ে আলোচনা-ভ্রমণের বৃত্তান্ত। এক সময় চন্দ্রাদি নিজের জীবন নিয়ে লেখা শুরু করলেন। উপলব্ধি করেছিলেন হয়তো জীবনের নশ্বরতাকে।

আরও পড়ুন: দেরি নেই, জঙ্গলে থাকব আমরা, অন্ধকারে জ্বলতেই থাকবে ট্রোলিংয়ের হিংস্র চোখ

এক দিন হঠাৎ ফেসবুকে গিয়ে জানলাম, চন্দ্রাদি চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে। সরাসরি ফেসবুকের মাধ্যমে কোনও প্রিয়জনের মৃত্যুসংবাদ এই প্রথম। চন্দ্রাদির বাড়ির ফোন নম্বর জানা নেই। আত্মীয়স্বজন কাউকেই চিনি না। ‘লাইক’ করব? ‘ইনস্ট্যান্ট মেসেজ’ পাঠাব চন্দ্রাদির অ্যাকাউন্টে? সেটাও তো বেশ হাস্যকর হবে। চুপ করে বসে রইলাম অনেক ক্ষণ। ভাবতে চেষ্টা করলাম কী করা উচিত। উত্তর পেলাম না। শুধু উপলব্ধি করলাম, ফেসবুকের সামাজিক উত্তরণের মেঠো পথটার পাকা হতে এখনও অনেক দেরি। ফেসবুক এখনও হয়তো শুধুই একটা স্বপ্নময় বিভ্রম। অথবা সেই হরিদ্বারের হর-কি-পৌরি ঘাটের হাজার হাজার ভাসমান দিয়ার মতো আলোয় ভরা এক সম্ভাবনা। এক সঙ্গে ভেসে চলেছে অনেক আলো। কেউ হয়ত টুপ্ করে নিভে গেল। বাকিরা তবু ভাসছে-হাসছে-গল্প করছে নিজেদের নিয়ে। জিজ্ঞেস করছে একে অন্যকে, কি রে, এ বার কী করবি?

অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন