গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় একবার আচমকাই এক সকালে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে গণেশের মূর্তি নাকি সত্যিকারের দুধ খাচ্ছে। দিল্লিতে প্রথম দেখা যায় রাস্তার ধারের ছোট ছোট মন্দিরে গণেশ মূর্তির সামনে দুধের বাটি ধরতেই তা থেকে মূর্তি সরাসরি দুধ টেনে নিচ্ছে। দাবানলের মতো সেই খবর ছড়িয়ে পড়তে লাগল, আর পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল মন্দিরের সামনে ভক্তদের লাইন। দিল্লি-তে সর্বোচ্চ আদালতের একজন বিচারপতিও ঘটনায় প্রভাবিত হয়ে গণেশ-কে দুধ খাইয়ে এলেন।
দিল্লি থেকে দেশের অন্য শহরে সেই খবর ছড়িয়ে পড়তেও সময় লাগল না, এমনকি সব জায়গাতেই গণেশের দুধ খাওয়া দেখতে মানুষের ভিড় জমল। দেশের বাইরে সিঙ্গাপুর, হংকং থেকেও গণেশের এই মহিমার খবর আসতে শুরু করল।
এ বার বিজ্ঞানীরা আসরে নামলেন। তাঁরা দিল্লি, কলকাতা সহ বিভিন্ন শহরে সাংবাদিকদের সামনে পরীক্ষা করে হাতেনাতে দেখালেন, শুধু গণেশ কেন, একই ধরনের পাথরের তৈরি অন্য কোনও বস্তুও একই ভাবে দুধ টেনে নিতে পারে, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় যাকে বলে ‘ক্যাপিলারি অ্যাকশন।’ বৈজ্ঞানিকদের এই ব্যাখ্যা ও হাতে কলমে তা করে দেখানোর পরে ভক্তদের মোহভঙ্গ হতে দেরি হয়নি। বিকেলের মধ্যেই গণেশ-এর দুধ খাওয়া নিয়ে মাতামাতি থিতিয়ে গেল।
তখনও মোবাইল যুগ শুরু হয়নি। হোয়াটসঅ্যাপ, ইন্টারনেট, ই-মেল, ফেসবুক, টুইটার আরও পরে আসবে। তখন সোশ্যাল মিডিয়া বলতে প্রধানত ল্যান্ডলাইন টেলিফোনই ভরসা। সেই ল্যান্ডলাইন টেলিফোন-এর মাধ্যমেই গণেশ-এর দুধ খাওয়া অল্প সময়ে দেশে ও দেশের বাইরে ছড়িয়েছিল। এখন মানুষের হাতে এসেছে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেটের সুবাদে ফেসবুক-টুইটার ইত্যাদি রয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি-র এই অভূতপূর্ব বিপ্লবে মৌলিক পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে মানুষের সামাজিক জীবনে, সংবাদমাধ্যমেও।
তথ্য প্রযুক্তি বিপ্লব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে পরিবর্তন এনেছে, তা এক কথায় বললে বলা যায়, সাধারণ মানুষকে সংবাদ ও তথ্যের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক দাসত্ব থেকে অনেকটাই মুক্ত করে দিয়েছে। এত দিন খবরের জন্য মানুষ পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল সংবাদমাধ্যম-এর উপর। সরকারি যাবতীয় নিয়ম ও নির্দেশ, যা কিনা সাধারণের জীবনে প্রভাব ফেলে, যেমন করের হার পরিবর্তন, শিল্প-বাণিজ্য ক্ষেত্রে নতুন নিয়ম রীতির প্রচলন বা দুর্ভিক্ষ, মহামারি, রাষ্ট্র বিপ্লবের আগাম সঙ্কেত ইত্যাদি বহুবিধ জরুরি খবর পাওয়ার জন্য মানুষ নির্ভর করত সংবাদমাধ্যমের উপর। গোড়ায় ছিল শুধুই সংবাদপত্র, সরকারি ও বেসরকারি। পরে সরকারি রেডিয়ো, টেলিভিশন আসে। আরও পরে বেসরকারি টিভিও রোডিয়ো।
কিন্তু সমস্যা হল, বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত সংবাদপত্র ও রেডিয়ো টোলিভিশন আয়ের জন্য একান্ত ভাবে নির্ভরশীল বিজ্ঞাপনের উপর। ফলে, দুই প্রধান বিজ্ঞাপনের উত্স রাষ্ট্র ও কর্পোরেট দুনিয়ার উপর সংবাদমাধ্যমের নির্ভরতা বাড়তে লাগল। সেই সঙ্গে বাড়তে লাগল সংবাদমাধ্যমের উপর রাষ্ট্র ও কর্পোরেট দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণ। এতে যে হিতে বিপরীত হয়, তার অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়। অমর্ত্য সেন তাঁর ফেমিন সংক্রান্ত আলোচনায় চিনের উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন, একবার সেখানে এক প্রদেশে খাদ্যশস্য উত্পাদন মার খাওয়ায় দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে লাখ লাখ মানুষ মারা যান। পাশের প্রদেশে উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য থাকা সত্ত্বেও তা আনা যায়নি, কারণ সরকারের কড়া নিয়ন্ত্রণে থাকা সংবাদমাধ্যম দুর্ভিক্ষ ও উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্যের খবর প্রকাশ করতে পারেনি।
চিন যদি স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সংবাদমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, তা হলে গণতন্ত্রের পীঠস্থান আমেরিকা-তেও সংবাদমাধ্যম পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণমুক্ত থাকতে পারেনি। নোয়াম চমস্কি দেখিয়েছেন, কী ভাবে খবর চেপে রেখে মার্কিন সরকার বছরের পর বছর ধরে লাতিন আমেরিকায় গুয়াতেমালা, নিকারাগুয়া, হাইতি প্রভৃতি একগুচ্ছ দেশে ভাড়াটে বাহিনী পাঠিয়ে, গোপনে অস্ত্রশস্ত্র পাঠিয়ে ও অর্থ ব্যয় করে সেই সব দেশের সরকার-কে ক্ষমতাচ্যুত করে, গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানির কারণ হয়েছে। এ সবই করা হয়েছে অনেক সময় মার্কিন কংগ্রেস-কে না জানিয়ে। সংবাদমাধ্যম-এর মালিকদের সঙ্গে গোপন বোঝাপড়া করে সেই খবর অনেক সময়ই প্রকাশ্যে আসতে দেয়নি তারা।
আজ তথ্য প্রযুক্তির এই বিপ্লবের যুগে এ ভাবে খবর চেপে দিয়ে সাধারণ মানুষকে বোকা বানানো বেশ কঠিন। সংবাদ ও তথ্য রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে (রাষ্ট্র ও কর্পোরেট জুনিয়ার জোট) রাখা ক্ষমতায় থাকার জন্য অপরিহার্য ছিল। এক দেশের শাসন ব্যবস্থায় সে দেশের মানুষ কতটা ভাল বা মন্দ আছেন তা বোঝা সম্ভব অন্য দেশের মানুষের জীবনের সঙ্গে প্রতিতুলনা করলে। তার জন্য দরকার এক দেশ থেকে অন্য দেশে খবরের অবাধ যাতায়াত। রাষ্ট্র খবরের এই অবাধ যাতায়াতের উপর নিয়ন্ত্রণ বসিয়ে সাধারণ মানুষকে তার ইচ্ছামতো ভাবতে ও চলতে বাধ্য করতে চায়।
বড় সংবাদমাধ্যমগুলিও এত দিন ধরে খবরের উপর নিয়ন্ত্রণ রেখে ইচ্ছামতো তাতে বিকৃতি ঘটিয়ে মানুষের কাছে তা প্রকাশ করে এসেছে। এ ভাবে তারা রাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন শক্তি, কর্পোরেট দুনিয়া এবং ক্ষমতার বিভিন্ন ভারকেন্দ্রগুলির স্বার্থ রক্ষা করে এসেছে। মিডিয়া মোগল রুপার্ট মারডক তো প্রকাশ্যেই দাবি করেন যে তিনি নিছক ব্যবসায় লাভের কথা ভেবে কাজ করেন না। তাঁর কাছে জনমনে প্রভাব বিস্তার করতে পারা, বা নিজের ইচ্ছার অনুকূলে জনমত-কে প্রভাবিত করতে পারাটা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের কাজ। ২০০৩ সালে ইরাকে আমেরিকার যুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে সংবাদমাধ্যমের এই ভূমিকা খুবই নগ্ন হয়ে দেখা দেয়। ইরাক দখলের পিছনে উদ্দেশ্য যে সে দেশের তৈলখনিগুলির উপর মার্কিন নিয়ন্ত্রণ আনা, সে কথা চেপে রেখে বুশ প্রশাসন যুদ্ধের অজুহাত হিসাবে দাবি করে, সাদ্দাম হুসেন তাঁর দেশে মারাত্মক সব গণ-ধ্বংসকারী অস্ত্রশস্ত্র (ওয়েপন অফ মাস ডেসট্রাকশন) তৈরি ও মজুত করেছেন। আগেই বুশ-এর সঙ্গে মার্কিন সংবাদমাধ্যম-এর গোপন বোঝাপড়া হয়ে গিয়েছিল। তার সঙ্গে যোগ দেয় টোনি ব্লেয়ারের নেতৃত্বে ব্রিটেন ও সে দেশের নামীদামি সংবাদ প্রতিষ্ঠান। যুদ্ধ শেষে সে সব অস্ত্রের কোনও সন্ধান পাওয়া গেল না। এ নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করল না বুশ, ব্লেয়ার ও সংবাদমাধ্যম।
এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় যে বিপ্লব ঘটে চলেছে, তাতে মানুষ আর সংবাদ-এর জন্য রাষ্ট্র ও কর্পোরেট দুনিয়া নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম-এর উপর আগের মতো নির্ভর নন। মানুষ নিজেই এখন সংবাদ জোগাড়, তৈরি ও পরিবেশনের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিতে শুরু করেছেন। তাঁরা এখন বেছে বেছে সেই সংবাদ ও তথ্য তুলে ধরছে, অন্যদের কাছে ছড়িয়ে দিচ্ছে, যা রাষ্ট্র ও কর্পোরেট দুনিয়ার পছন্দ তো নয়ই, অনেক সময়ই তা ক্ষমতাসীন সরকার ও কর্পোরেট দুনিয়ার স্বার্থের বিপরীত। বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকি দিয়ে চলা বড় শিল্পপতি ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে অশুভ আঁতাত, তা এখন সোশ্যাল মিডিয়ার আক্রমণের সামনে অনেক সময় বিপন্ন। এ দেশেই হোক বা বিদেশে, ইদানিং কালে বার বার সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রবিপ্লব ঘটে যাওয়া তার-ই ইঙ্গিত। মিশর দেশে এই বিপ্লব হোসনে মোবারকের একচ্ছত্র শাসনের আবাসন ঘটিয়েছে। বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়া একাত্তরের গণহত্যার অপরাধীদের বিচারের জন্য সরকারের উপর চাপ তৈরি করতে সফল হয়েছে। চিনে সে দেশের একনায়কতন্ত্রের কড়া শাসনের মধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়া একসঙ্গে অনেক শহরে শ্রমিক ধর্মঘট গড়ে তুলেছে। অবশ্য, সোশ্যাল মিডিয়ার এই শক্তির পরিচয় পেয়ে চিনের কমিউনিস্ট সরকারও বসে থাকেনি। তারা ফেসবুক থেকে ইন্টারনেট, সর্বত্র কড়া নিয়ন্ত্রণের পাহারা বসিয়েছে। কিন্তু এই কড়া প্রহরের ফাঁক দিয়েই সাধারণ মানুষ দেশে দেশে নিজেদের ক্ষমতায়ন বাড়িয়ে চলেছে। সোশ্যাল মিডিয়া তাদের কাছে ক্ষমতায়নের হাতিয়ার।
এটা ঠিক, অন্য যে কোনও হাতিয়ারের মতোই এরও অপব্যবহারের আশঙ্কা আছে, তা আছেও। যেমন, ‘হেট ক্যাম্পেন।’ যে সোশ্যাল মিডিয়াকে নির্ভর করে সাধারণ মানুষ ক্ষমতাশীল শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তার-ই মাধ্যমে জাতি-ধর্ম-গোষ্ঠী পরিচয়কে কেন্দ্র করে বিভেদ তৈরির জন্য ‘হেট ক্যাম্পেন’-ও চলছে এই সোশ্যাল মিডিয়া -র মাধ্যমেই। মিথ্যা তথ্য সম্বলিত ফেক নিউজ বা ইতিহাসের বিকৃত বিবরণ, এ সবই ওই ‘হেট ক্যাম্পেন’-কে এগিয়ে নিয়ে যায়। তাই বলে সোশ্যাল মিডিয়ার ইতিবাচক দিক অস্বীকার করা মূর্খামি। সোশ্যাল মিডিয়া এসেছে, থাকবে। দিনে দিনে তা আরও শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত হবে সাধারণ মানুষের হাতে।