প্রশ্ন: ভারতের উন্নয়ননীতিতে একটা বড় পরিবর্তন এসেছিল ইউপিএ সরকারের আমলে— কর্মসংস্থান, শিক্ষা, খাদ্যের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষের অধিকার আইনের স্বীকৃতি পেয়েছিল। নরেন্দ্র মোদী সেই পথে হাঁটেননি। স্বাস্থ্যের অধিকারের বদলে তিনি ব্যবস্থা করলেন আয়ুষ্মান ভারতের, যেখানে সরকার শুধু বিমার প্রিমিয়ামের একটা অংশ দেবে, পরিষেবা থাকবে প্রধানত বেসরকারি সংস্থার হাতে।
প্রণব বর্ধন: আয়ুষ্মান ভারতের প্রসঙ্গে আসব, কিন্তু তার আগে গোড়ার কথাটা বলে নিই। আইন তৈরি করলেই তো হয় না, দেখতে হবে, তাতে কতটা কাজ হচ্ছে। রাইট টু এডুকেশনের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হল রাইট টু লার্নিং। সেটা হচ্ছে কি? বাচ্চারা কি শিখছে? না কি, আমলাতন্ত্রে আটকে যাচ্ছে শেখার অধিকার? একটা প্রকৃত আন্দোলন ছাড়া কোনও অধিকারই প্রতিষ্ঠিত হবে না। খাদ্যের অধিকার এখন এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে সেটাকে সরালে খুব গোলমাল হবে গোটা দেশেই। কিন্তু, রাইট টু লার্নিং কি সেই জায়গাটা পেয়েছে এখনও? আমি এই কারণেই শিক্ষার অধিকার আইন সম্বন্ধে খুব একটা আশাবাদী ছিলাম না। আইন জরুরি, কিন্তু নীচ তলা থেকে একটা আন্দোলন, দাবি তৈরি না হলে শুধু আইন দিয়ে কাজ হবে না।
প্র: অমর্ত্য সেনরা মনে করেন, প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বেসরকারি উপস্থিতি একেবারেই বাঞ্ছনীয় নয়। পুরোটাই সরকারের হাতে থাকা উচিত। আপনি কী বলবেন?
উ: আমি মনে করি, আগে দেখতে হবে কোনও জায়গায় যথেষ্ট সংখ্যক সরকারি স্কুল আছে কি না। সেখানে শিক্ষক আছেন কি না, তাঁরা আসেন কি না। যেখানে এগুলো আছে, সেখানে সরকারি স্কুলের উপস্থিতিই বাঞ্ছনীয়। যথেষ্ট স্কুলের জোগান না থাকলে বেসরকারি স্কুলকে সরিয়ে দেওয়ায় আমার মত নেই। অমর্ত্যদারা কেরলকে খুব পছন্দ করেন। কেরল কিন্তু বেশির ভাগটাই বেসরকারি স্কুলের দিকে চলে যাচ্ছে। আর একটা কথা তো থেকেই যায়, সব সরকারি স্কুল করে দেওয়া মানে আমরা বেঁধে দেব, গরিব মানুষ কোথায় খরচ করবেন।
প্র: সরকারি স্কুলে বা হাসপাতালে তো খরচের প্রশ্ন নেই।
উ: নিশ্চয়ই আছে। তুমি সরকারি হাসপাতালে যাও, হরহামেশা শুনবে যে ওষুধ নেই। বাইরে থেকে কিনতে হবে। হাসপাতালের বহির্বিভাগে দেখাতে গেলে ডাক্তার অনেক সময় উৎসাহ দেন তাঁর প্রাইভেট চেম্বারে গিয়ে দেখাতে। এ তো পিছনের দরজা দিয়ে বেসরকারি ক্ষেত্রকে ডেকে আনা।
প্র: কিন্তু, এই সমস্যা তো প্রশাসনিক ভাবে ঠেকানো যায়। কঠিন, তবে অসম্ভব নয়।
উ: প্রশাসনিক ব্যবস্থার চেয়েও আন্দোলনের গুরুত্ব বেশি। আন্দোলন মানে শুধু রাস্তায় নেমে স্লোগান দেওয়া নয়। নাগাল্যান্ডে যেমন কিছু পঞ্চায়েতে নিয়ম বেঁধে দেওয়া হল, শিক্ষক বা ডাক্তারদের মাইনের একটা অংশ স্থির করবে স্থানীয় পঞ্চায়েত। পঞ্চায়েতের সদস্যরা তো জানেন, কোন ডাক্তার হাসপাতালে আসছেন, কে আসছেন না। ফলে, প্রায় রাতারাতি অবস্থা পাল্টে গেল। এই বিকেন্দ্রী করণটা দরকার। এটাই রাজনীতি। প্রশাসনিক কাঠামোর বাইরের উদ্যোগ।
প্র: রাজনীতির কথা বলছেন, কিন্তু আপনার কি মনে হয় না যে ভারতের মূলধারার রাজনীতিতে শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের প্রসঙ্গ ভয়ানক রকম অনুপস্থিত?
উ: শিক্ষার সম্বন্ধে এখন দরিদ্র মানুষরাও অনেক বেশি সচেতন। সরকারি স্কুলে পড়াশোনা হচ্ছে না বলে তাঁদের মধ্যে বেসরকারি স্কুলের চাহিদা বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে নিজেরা অশিক্ষিত বলে তাঁরা ধরতে পারেন না যে কোন শিক্ষক ঠিক করে পড়াচ্ছেন, আর কে ফাঁকি দিচ্ছেন, অথবা বাচ্চারা যথেষ্ট শিখছে কি না। কিন্তু, স্কুলে শিক্ষক আসছেন কি না, সেটা নিয়ে মানুষের যথেষ্ট সচেতনতা আছে। স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও সরকারি ক্লিনিকে ডাক্তার থাকছেন কি না, সে বিষয়ে যদি সচেতনতা থাকেও, কোনটা রোগের প্রকৃত চিকিৎসা আর কোনটা হাতুড়ে চিকিৎসা, সে সম্পর্কে ধারণা কম।
ভারতে দলিতদের সম্বন্ধে একটা বেফাঁস মন্তব্য করলে কোনও রাজনীতিকের ভোটে জেতা মুশকিল হয়ে যেতে পারে। ততখানিই সচেতনতা আছে। সেটা ভাল। কিন্তু, যে সেই একই নেতার নীতির ভুলে যদি দলিতদের বাচ্চা মরে যেতে থাকে, ভোটে কি ততখানি প্রভাব পড়বে? মনে হয় না। বাচ্চা যে ভগবানের ইচ্ছায় মরে না, তার পিছনে কার্যকারণ আছে, নীতিগত ভুল আছে, এই কথাটাই ভারতে এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আমি বলব, এটা বামপন্থীদের একটা মস্ত গাফিলতি।
কেরলে খানিকটা সচেতনতা তৈরি হয়েছে, কিন্তু বাকি ভারতে এটা দৈনন্দিন রাজনীতির অঙ্গ হয়নি। স্বাস্থ্য যে মানুষের অধিকার, এই কথাটা সাধারণ মানুষ এখনও স্পষ্ট ভাবে বোঝেননি। ভগবানই দিয়েছিল, ভগবানই নিয়ে নিয়েছে, এমন একটা ধারণার ওপর গোটা ব্যাপারটা চলছে। আসলে যে ওলাবিবি নয়, জল দূষিত বলে আমাশা বা কলেরা হয়ে বাচ্চা মারা গিয়েছে, এই কথাটা মানুষকে বোঝাতে হলে বিজ্ঞান আন্দোলন প্রয়োজন। পশ্চিমে হয়েছে, আমাদের এখানে এখনও হল না। বামপন্থীদের ব্যর্থতা তো বটেই।
ভারতে সুপ্রিম কোর্ট এখন খাদ্যকে জীবনের অধিকারের অঙ্গ হিসেবে মেনে নিয়েছে। স্বাস্থ্য তো আরও প্রত্যক্ষ ভাবে জীবনের সঙ্গে জড়িত— আক্ষরিক অর্থেই জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন সেখানে। স্বাস্থ্যের অধিকারকে আইনের মর্যাদা দেওয়ার দাবি ওঠা উচিত তো বটেই। ভারতে ওঠে না।
প্র: আয়ুষ্মান ভারত দিয়ে তো স্বাস্থ্যকে সেই জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
উ: তা তো বটেই। তার চেয়েও বড় কথা হল, নামটা নতুন, কিন্তু ব্যাপারটা তো নতুন নয়। ইউপিএ-র আমলেও এ রকম স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা ছিল। তখন ৩০,০০০ টাকা পর্যন্ত সরকার বিমা-ভর্তুকি দিত, এখন বলছে পাঁচ লাখ দেবে। কিন্তু, সেই ৩০,০০০ টাকার প্রকল্পও বেশির ভাগ রাজ্যে কার্যকর হয়নি। উত্তরপ্রদেশে হয়নি, বিহারে হয়নি। দক্ষিণ ভারতের কিছু রাজ্যে হয়েছে। রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনা চলল না কেন, সেই কারণ সন্ধান না করে বিমার ঊর্ধ্বসীমা বাড়িয়ে দিলেই কি হবে?
তার পরের কথা হল, পুরোটাই বেসরকারি স্বাস্থ্যবিমার মাধ্যমে করার চেষ্টা হচ্ছে। তাতে বিমা সংস্থাগুলোর লাভ, কিন্তু সাধারণ মানুষের ক্ষতি হতে পারে। বিমার মূল কথা হল, যত বেশি মানুষ কোনও একটি নির্দিষ্ট বিমার আওতায় আসবে, ঝুঁকির পরিমাণও তত ছড়িয়ে যাবে, ফলে প্রিমিয়াম কমবে। অনেকগুলো বেসরকারি বিমা সংস্থার মধ্যে ভেঙে দিলে এই ‘রিস্ক পুল’-টা ছোট থাকে, ফলে প্রিমিয়াম বাড়ে। সরকারের টাকা খরচ বেশি হয়। বিমাটা সরকারি হাতে থাকলে খরচ কমত। কানাডা ও ফ্রান্সে সেই ব্যবস্থা আছে। পাশের দেশ তাইল্যান্ডেও আছে। সরকারি-বেসরকারি, দুই ধরনের হাসপাতাল যদি পরিষেবার ক্ষেত্রে থাকেও, খরচের দায়িত্ব পুরোটাই সরকারের হাতে থাকা জরুরি। বিমার ক্ষেত্রে তা হলে রিস্ক পুল বাড়বে, প্রিমিয়াম কমবে। ওষুধ কেনার ক্ষেত্রেও ওষুধের কোম্পানিগুলোর সঙ্গে দরাদরি করতে সুবিধা হবে।
বিমা ক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থা থাকলে তারাই ধীরে ধীরে পুরো ব্যবস্থাটাকে কবজা করে নেয়। যেমন আমেরিকায় করেছে। তার ওপর, বিমার টাকা পাওয়া গেলেও তা শুধু হাসপাতালে ভর্তি থাকার জন্য— ভর্তি না হয়ে ডাক্তার দেখানোর জন্য নয়, বাড়িতে খাওয়া ওষুধের জন্যও নয়। সেই খরচগুলো বিরাট। বিশেষত গরিব মানুষের পক্ষে। আর একটা জিনিস হল, ভারতে কর্পোরেট হাসপাতালগুলো ইতিমধ্যেই আপত্তি করছে যে এই টাকায় তাদের পোষাবে না। ফলে, আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পে আসলে লাভবান হবে মাঝারি মাপের বেসরকারি হাসপাতালগুলো, যাদের পরিষেবার গুণমান নিয়ে কিছু প্রশ্ন থাকতে পারে।
প্র: টাকাও কি যথেষ্ট আছে? ভারতে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়বরাদ্দ খুবই কম।
উ: জিডিপির এক শতাংশ থেকে বাড়িয়ে স্বাস্থ্যখাতে খরচ অন্তত দুই বা তিন শতাংশ করা উচিত। বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশেই সেই পরিমাণ টাকা স্বাস্থ্যখাতে খরচ হয়। কিন্তু, প্রশ্নটা শুধু টাকার নয়। ভারতের দরিদ্রতম ন’টা রাজ্যের হিসেবে দেখেছি, স্বাস্থ্যখাতে যে সামান্য টাকা আসে, সেটাও রাজ্যগুলো খরচ করতে পারে না। টাকা ফিরে যায়। কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া এই ত্রুটি শুধরানোর নয়।
প্র: এত ক্ষণ যে কথা হল, তাতে মনে হচ্ছে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সরকারের উপস্থিতি বাড়লে অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে। কিন্তু, ভারতীয় রাজনীতিতে এই দাবি ওঠে না কেন?
উ: কারণ, মানুষ অভিজ্ঞতায় জানে যে সরকারি জায়গায় পরিষেবা পাওয়া যায় না। তার জন্যই রাজনীতির কথা বলছিলাম। সরকারি পরিকাঠামো থেকে পরিষেবা পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দাবি তৈরি করা ছাড়া উপায় নেই। এই নিয়ে শ্রমিক আন্দোলনের নেতাদের ভাবতে হবে।
সাক্ষাৎকার: অমিতাভ গুপ্ত
প্রণব বর্ধন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফর্নিয়া (বার্কলে)-র অর্থনীতির প্রফেসর এমেরিটাস