সম্পাদকীয় ১

শম্ভুলালের ভারত

শুধু কিছু হত্যায় রাষ্ট্রীয় আপত্তির অভাব বা কার্যত অনুমোদনই গোটা দেশকে শম্ভুলাল রেগরদের জন্য মুক্তাঞ্চল করিয়া তোলে নাই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:০৪
Share:

দাদরিতে যাহারা মহম্মদ আখলাকের বাড়িতে চড়াও হইয়াছিল, খুন করিতে যাওয়ার পূর্বে তাহাদের দল বাঁধিবার প্রয়োজন পড়িয়াছিল। শম্ভুলাল রেগর সেটুকুরও অপেক্ষা করে নাই। আফরাজুল খানকে হত্যার দৃশ্যটি মোবাইল ক্যামেরায় রেকর্ড করিয়া রাখিতে পারিবে, এমন একটি সহযোগীই তাহার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। কারণ, অনুমান করা চলে যে শম্ভুলাল জানিত, ‘লাভ জেহাদ’ বা অন্য কোনও অজুহাতে কোনও এক মুসলমানকে কোপাইয়া, জ্বালাইয়া দিলে এই ভারতে— নরেন্দ্র মোদীর ভারতে— তাহার পিছনে দাঁড়াইবার লোকের অভাব হইবে না। খুন করিতে যাইবার জন্য তাহার আর দলের দরকার নাই, গোটা দেশই কার্যত তাহার দল। একটি খুন করিয়া সেই দৃশ্যের ভিডিয়ো রেকর্ডিং সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়াইয়া দেওয়ার মধ্যে যে দুঃসাহস আছে, এত দিন তাহা আইএস-এর একচেটিয়া বলিয়াই জানা ছিল। শম্ভুলাল রেগর প্রমাণ করিল, হিন্দুত্ববাদীরাও সেই সাহস অর্জন করিয়াছে। এবং, সেই সাহসের উৎস অভিন্ন। আইএস-এর জঙ্গিরা যেমন জানিত যে নিজেদের ঘাঁটিতে তাহাদের টিকিটি ছুঁইবার ক্ষমতা কাহারও নাই, শম্ভুলালও সেই বিশ্বাসেই সাহসী হইয়াছে। ফারাক হইল, রাকা-র ন্যায় কোনও সীমিত পরিসর নহে, শম্ভুলালদের ঘাঁটি এখন গোটা ভারত। তাহারা বিশ্বাস করে, নরেন্দ্র মোদীর ভারতে তাহারা অবধ্য। রাজস্থান পুলিশ শম্ভুলালকে গ্রেফতার করিল কি না, সেই তথ্যে এই বিশ্বাসের গায়ে আঁচ়ড় প়়ড়িবে না।

Advertisement

কারণ, বিশ্বাসটি এক দিনে, বা কোনও একটি ঘটনায় তৈরি হয় নাই। শম্ভুলাল রেগর জানে, এই দেশে গোমাংস ভক্ষণের অজুহাতে এক জন মুসলমানকে পিটাইয়া মারিবার পরও অভিযুক্তদের সরকারি চাকুরি পাইতে সমস্যা হয় না (বস্তুত, সুবিধা হয় কি না, তাহাই প্রশ্ন), চাকুরি না পাইলেও নিদেনপক্ষে গায়ে হাওয়া লাগাইয়া ঘোরা যায়। এ দেশে এম এম কালবুর্গি বা গৌরী লঙ্কেশের হত্যাকারীদের খুঁজিয়াই পাওয়া যায় না। এই দেশে মুসলমানদের নিকট যখন প্রতি পদে ‘দেশভক্তি’র প্রমাণ চাওয়া হয়, প্রশাসন নির্বিকার থাকে, অথবা যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যে সেই চাহিদায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। শম্ভুলালরা জানে, এই ভারত আর গাঁধী-রবীন্দ্রনাথ-নেহরুর নহে, এই ভারত এখন সাভারকর-গোলওয়ালকর-হেডগাওয়াড়দের। রাষ্ট্র এখন মুসলমানদের সমনাগরিকের মর্যাদা দিতে অস্বীকার করে। অতএব, শম্ভুলালরা জানে, এই ভারতে মুসলমান-মৃগয়ায় গেলে রাষ্ট্র আপত্তি করিবে না। কপাল ভাল হইলে পিঠ চাপড়াইয়াও দিতে পারে।

শুধু কিছু হত্যায় রাষ্ট্রীয় আপত্তির অভাব বা কার্যত অনুমোদনই গোটা দেশকে শম্ভুলাল রেগরদের জন্য মুক্তাঞ্চল করিয়া তোলে নাই। আরও বিপজ্জনক প্রতিটি পদক্ষেপে বিভাজনের রাজনীতি। মহম্মদ আখলাক বা পেহলু খান বা জুনেইদ খান বা গৌরী লঙ্কেশের হত্যার পর যে প্রধানমন্ত্রী টুঁ শব্দটি করেন নাই,‘পদ্মাবতী’-কে কেন্দ্র করিয়া হিন্দুত্ববাদীদের প্রলয় নাচনের নীরব সাক্ষী থাকিয়াছেন, তিনিই কিন্তু উত্তরপ্রদেশে শ্মশান আর করবস্থানের তুল্যমূল্য বিচার সারিয়াছেন। নরেন্দ্র মোদীর ভারত প্রতি পদক্ষেপে বুঝাইয়া দিয়াছে, এই দেশে মুসলমানদের ঠাঁই নাই। এই দেশে এখন অসহনশীলতাই ধর্ম। শম্ভুলাল রেগররা সেই ধর্মেরই সন্তান। তলাইয়া ভাবিবার মতো শিক্ষা তাহাদের নাই, সহাবস্থানের ধৈর্যটুকুও তাহারা ছাপ্পান্ন ইঞ্চির বেদিতে নৈবেদ্য চড়াইয়া আসিয়াছে। রাষ্ট্র তাহাদের অসহনশীলতাকে রক্ষাকবচ দিয়াছে। বসুন্ধরা রাজের পুলিশ এক জন শম্ভুলাল রেগরের বিরুদ্ধে কতখানি কঠোর ধারায় মামলা করিল, সেই প্রশ্ন আসলে অবান্তর— নরেন্দ্র মোদীর ভারতে তাহারা অবধ্য। কারণ, তাহারাই ভারত। গোলওয়ালকরের ভারত।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন