সম্পাদকীয় ১

নির্বোধ

বুঝিতে অসুবিধা নাই, সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে কীভাবে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপির এই ধর্ম-রাজনীতির চাপ বোধ করিতে পারে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০১৮ ০০:৫৬
Share:

নিষেধ সত্ত্বেও এই বৎসরও রামনবমীর মিছিলে অস্ত্রের উপদ্রব অব্যাহত। নেতার মন্তব্য: অস্ত্র তো আলংকারিক, গোল পাকাইবার জন্য তাহাদের আমদানি নহে। রাজনৈতিক নেতাদের ব্যবহারিক বোধ লইয়া প্রশ্ন তুলিতে নাই, বিশেষত সবে দলে যোগ দিয়াছেন এমন নেতার অতিরিক্ত ‘হিন্দুত্ব’ দেখাইয়া নিজেকে গোত্রভুক্ত করিবার দায়টি তো সহজবোধ্য, তবু জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করে যে, অন্যান্য পূজায় যখন দেবদেবীর অলংকারস্বরূপ অস্ত্রগুলি সত্যকারের হয় না, মাতা দুর্গার হাতে রাংতা আর কার্ডবোর্ডের তরবারি-ত্রিশূল যখন যুগ-যুগের ঐতিহ্য, সম্প্রতি তবে নূতন কী হইল যে শিশুদের হাতেও বড় বড় শাণিত তলোয়ার ধরাইয়া দিতে হইতেছে? কলিকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের অন্যত্র ‘ধর্মীয় মিছিল’-এর নামে এই ভয়ানক উগ্রতা, বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ, ছোট-ছোট শিশুর হাতে তীক্ষ্ণ অস্ত্রের ঝলক— সব মিলাইয়া উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ ঘটে যে এ রাজ্যের ভবিষ্যৎ হিংসাকবলিত। কয়েক বৎসর আগেও পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব পর্বতালিকায় এই উৎসবের অস্তিত্বই ছিল না মোটে, অথচ আজ তাহারই প্রবল আস্ফালন ও হিংসা-হুমকির প্রবাহ। এত দ্রুত এমন ব্যাপক পরিবর্তন সম্ভব করিল এ রাজ্যে বিজেপি সংগঠনের স্ফুরণ। হিন্দু ধর্ম পশ্চিমবঙ্গে নূতন বস্তু নহে। কিন্তু বিজেপি এ রাজ্যে হিন্দু কথাটির অর্থ দ্রুত পালটাইয়া দিতেছে। অনেক কাল ধরিয়া চলিয়া আসা সমাজকে একটানে ছিঁড়িয়া ফেলিয়া আজ তাহারা হিন্দুধর্মের নামে হিন্দুত্ববাদের প্রতিষ্ঠা করিতেছে, বাঙালির ভক্তিবাদ ও সহনশীলতার প্রদীপটি নিবাইয়া উত্তর ভারতের অসহিষ্ণু সংকীর্ণ ধর্মধারাটিকে খাল খুঁড়িয়া ডাকিতেছে। সকল শুভবোধ মুছিয়া দিয়া অস্ত্র এখন আর দেবতার অলংকার নহে, ‘অন্যদের’ ভয়ে কুঁকড়াইয়া দিবার মাধ্যম। যাঁহারা ভাবিতেছেন, রামনবমীর মিছিল ধর্মের উৎসব, তাঁহারা চোখে ঠুলি আঁটিয়াছেন। ইহা ধর্ম নহে। ইহা নিখাদ রাজনীতি। যে রাজনীতি সতত ‘অন্য’দের সন্ত্রস্ত রাখিতে চায়।

Advertisement

এবং যে রাজনীতি অন্য রাজনৈতিক দলগুলিকেও নিজেদের ভাবনাতেই ভাবাইতে চায়। বুঝিতে অসুবিধা নাই, সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে কীভাবে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপির এই ধর্ম-রাজনীতির চাপ বোধ করিতে পারে। হিন্দু উৎসব বা অনুষ্ঠান হইতে নিজেরা দূরে সরিয়া দাঁড়াইয়া বিজেপিকে হিন্দু সংস্কৃতির একমাত্র ধারক-বাহক হইতে দেওয়া হয়তো তাহাদের পক্ষে এখন বিরাট ঝুঁকির বিষয়। প্রতিযোগিতামূলক গণতন্ত্রে প্রতিযোগিতামূলক ধর্মবোধ-প্রদর্শনের তাগিদটিও সর্বত্রবিহারী: কেবল এ রাজ্যে কেন, গোটা দেশের বিরোধী দলনেতারাই এই দুর্ভাগ্যময় কথাটি হৃদয়ঙ্গম করাইতেছেন। কিন্তু প্রতিযোগিতা এক কথা, আর বিপজ্জনক সংকীর্ণতার পথে সমাজকে চালনা করা আর এক কথা। হিন্দু মানুষকে কাছে টানিবার চেষ্টা করা এক কথা, আর উদভ্রান্ত হিন্দুত্ববাদ দিয়া মানুষকে বিপথে চালনা করা আর এক কথা। বিজেপি এই সীমারেখা মানে না। কিন্তু বিজেপি-বিরোধী দলগুলিও যদি দেখাদেখি ধর্মের নামে অসহিষ্ণুতার কারবার হইতে নিরস্ত না হয়, তবে তাহাদের সহিত বিজেপির ফারাক কোথায়। তৃণমূল নেতৃত্ব ভাবিয়া দেখুক, এ রাজ্যে রামভক্তির রাতারাতি স্ফুরণে সক্রিয় সহায়তা করিয়া তাঁহারা নিজেদের রাজনীতির মঙ্গল করিতেছেন, না কি বিজেপির রাজনীতির প্রকল্পটিকেই কয়েক পা আগাইয়া দিতেছেন? তাঁহারা কি বিজেপির দ্বিতীয় দল হইতে চাহেন? না কি বাঙালির উদার সংস্কৃতিটির প্রতিনিধি হইতে চাহেন? তবে একটি শেষ কথা। সব দায় তো শুধু রাজনীতিকদেরই নহে। যাঁহারা রাজনীতিকদের বাঁশি বাজিলেই কচ্ছ-উদ্ঘাটন করিয়া পড়িমরি ছুটিয়া আসেন, নিজেদের শিশুদের অবোধ হাতে অস্ত্র তুলিয়া দেন, সেই নাগরিকরাও ভাবিয়া দেখুন, নবলব্ধ এই ধর্ম-রাজনীতির নির্বোধ উন্মত্ততায় তাঁহারা আর কত দূর তাল মিলাইতে চাহেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন