Intolerance

স্কুলেও যখন অসহিষ্ণুতা

‘এলিট’ স্কুলে ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের মধ্যে অসহিষ্ণুতার এই প্রকাশ বোধ হয় এক শতক আগেও ছিল না। সহিষ্ণুতার চারাগাছ পোঁতা হত অনেক সময় স্কুলের মাটিতেই।

Advertisement

শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:০২
Share:

সম্প্রতি কলকাতায় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সম্প্রদায় পরিচালিত স্কুলগুলোর অধ্যক্ষদের সর্বভারতীয় আলোচনাসভা হয়ে গেল। কাগজে পড়লাম, অধ্যক্ষেরা এই মুহূর্তের যে মুখ্য চ্যালেঞ্জগুলি নিয়ে আলোচনা করেছেন, তার মধ্যে বিশেষ জায়গা পেয়েছে স্কুল চত্বরে অসহিষ্ণুতার প্রকাশ। ইদানীং নাকি প্রায়ই অভিভাবকেরা স্কুলে এসে অনুরোধ জানাচ্ছেন, ক্লাসে তাঁদের শিশুর বসার জায়গা বদল করে দিতে। কারণ পাশে বসা শিশুটির আনা টিফিনে আমিষ খাবারের ভাগ তাঁদের বাড়ির বাচ্চাটি পেলে, পরিবারের ‘ধর্মীয় মূল্যবোধ’ আহত হচ্ছে। লক্ষণীয়, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়-প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত স্কুলে ছেলেমেয়েদের পড়তে পাঠিয়ে সংখ্যাগুরু বাপ-মায়েরা এ সব বলছেন। টিফিনের সময় খাদ্যাভ্যাস অনুযায়ী বাচ্চারা গ্রুপ করে বসছে, পছন্দের বন্ধুদের সঙ্গে বসছে না। অধ্যক্ষদের রীতিমতো মিটিং ডেকে বাপ-মায়েদের বোঝাতে হচ্ছে, তাঁদের অসহিষ্ণুতা ছেলেমেয়ের সহজ বন্ধুত্ব নষ্ট করে দিচ্ছে।

Advertisement

‘এলিট’ স্কুলে ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের মধ্যে অসহিষ্ণুতার এই প্রকাশ বোধ হয় এক শতক আগেও ছিল না। সহিষ্ণুতার চারাগাছ পোঁতা হত অনেক সময় স্কুলের মাটিতেই। স্কুল তৈরি করতেন যে সব শিক্ষাবিদ সমাজকর্মী, তাঁদের অনেকেই জাতির ঐক্য ও সংহতি রক্ষায় স্কুলগুলোর বিরাট ভূমিকায় বিশ্বাস করতেন। স্বাধীন ভারতে ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে এক ‘মহাজাতির উত্থান’-এর স্বপ্ন ছিল তাঁদের চোখে।

একটা উদাহরণ দিই। কলকাতার বুকে ঠিক ১০০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল গোখেল মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল। বিলেতফেরত ব্রাহ্মিকা সরলা রায়-এর তৈরি এই স্কুলে ১৯২০-এর দশকেই মাইনে ছিল প্রতি মাসে ১০ টাকা, ১৯৪০-এর দশকে ২০/২২ টাকা। ভাষা ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে ‘অভিজাত’ বংশের মেয়েরা পড়তে যেতেন সেই স্কুলে। ত্রিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে গোখেল মেমোরিয়ালে যাঁরা ছাত্রী ছিলেন, বছর দশেক আগে ‘কলকাতায় আধুনিক স্কুল তৈরির ইতিহাস’ নিয়ে আইডিএসকে-র একটি গবেষণায় জেনেছি যে, ওই স্কুলে কোনও ধর্মীয় উৎসব পালিত হত না। নানা ভাষাভাষী মেয়েরা পড়তেন, মুসলমান পরিবারের মেয়েরাও।

Advertisement

প্রাক্তনীদের স্মরণে ছিল, সকালে অ্যাসেম্বলির সময় এক-এক দিন এক-একটা ধর্মগ্রন্থ থেকে অল্প কিছু পাঠ হওয়ার কথা। উঁচু ক্লাসে ‘কমপ্যারেটিভ রিলিজিয়ন’ নামক একটি বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত করানো হত তাঁদের। শুধু যে বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে ছাত্রীদের ধারণা দেওয়া হত তা-ই নয়, নানা সামাজিক বিষয়েও— যেমন অসবর্ণ ও আন্তঃধর্মীয় বিয়ে নিয়ে আলোচনা উস্কে দেওয়া হত তাঁদের মনে। শিক্ষিকাদের মধ্যেও ছিলেন নানা ভাষা ও সম্প্রদায়ের মানুষ। প্রতিষ্ঠাত্রীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে স্কুলের শক্ত ভিত গেঁথেছিলেন পরমপ্রিয় বাঙালি খ্রিস্টান অধ্যক্ষা শ্যামসোহাগিনী রানি এমিলি ঘোষ।

সরলা রায় ও তাঁর বিশেষ শ্রদ্ধেয় বন্ধু গোপালকৃষ্ণ গোখেল-কে নিয়ে একটা গল্প শুনেছিলাম প্রাক্তনীদের মুখে। সরলা জাতপাত মানতেন না এবং গোখেলও জাতিভেদের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন। বেশি বয়সে তাঁর সঙ্গে সরলার আলাপ হওয়ার পর দু’জনের মধ্যে জাতিভেদ নিয়ে আলোচনার সময় এক দিন সরলা গোখেল-কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেছিলেন, ‘‘আপনি তা হলে পৈতেটা এত বছরেও খুলে ফেলেননি কেন?’’ এর কিছু দিন বাদে সরলা রায়ের ঠিকানায় একটা খাম এসেছিল। প্রেরক গোখলে। খামের মধ্যে টুকরো টুকরো করে কাটা প্রেরকের পৈতে!

এ দেশে ধর্মনিরপেক্ষ স্কুলের অন্যতম প্রথম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল গোখেল স্কুল। এই স্কুলের নিয়মাবলিতে ১৯২৯ সালে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা ঘোষিত হল। ঠিক পরের বছরেই ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়ের পরিচালনা সমিতি স্কুলটির ট্রাস্ট-ডিডে যোগ করলেন একটি নতুন ধারা—‘জাতিধর্ম-নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের জন্য এ শিক্ষালয়ের দরজা খোলা থাকবে।’ উনিশ শতকের শেষে শুধুমাত্র ব্রাহ্ম মেয়েদের জন্যে স্থাপিত হয়েছিল এই স্কুল। নানা বাধা অতিক্রম করে ১৯১০-এর পর থেকে অবলা বসুর নেতৃত্বে তার দরজা সব মেয়েদের জন্য খুলে দেওয়া হল।

স্কুল চত্বরের বাইরে অন্য ধর্মের মানুষদের সঙ্গে এই সব স্কুলের ছাত্রীদের মেলামেশা ও জানাচেনা হয়তো ছিল নামমাত্র। দূরত্ব অবশ্যই ছিল। আমাদের সামাজিক কাঠামোর নানা বৈষম্যকে বদলানোর কোনও চেষ্টাও ছিল না স্বাধীনতা-দেশভাগ পরবর্তী সময়ে। কিন্তু বিদ্বেষ-অসহিষ্ণুতা ও দূরত্ব এক নয়। ১৯৫০-এ আগে-পরে এই সব স্কুলে যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের মজ্জায় গেঁথে দেওয়া হয়েছিল সংবিধানের মানবিকতা ও সহ-নাগরিকত্বের বোধ— যে বোধ ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়, লিঙ্গ, ভাষার ভিত্তিতে মানুষকে দূরে ঠেলে দেয় না। আজ যখন দেশের বহু মানুষ সংবিধানের কাছে সঙ্কট-কালে আশ্রয় খুঁজছেন, তখন প্রাক্-সংবিধান পর্বে তৈরি আরও কিছু ধর্ম-নিরপেক্ষ স্কুলের ইতিহাস থেকে হয়তো আমাদের অনেক কিছু শেখার থাকতে পারে। আর ভেদ-বিভেদ প্রতিরোধে আমাদের শিক্ষার ইতিহাসে সরলা-অবলা-রোকেয়া-এমিলিদের অবদানের কথাটাও ফেলনা নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন