নামভূমিকায়
arvind kejriwal

মরণপণ জেদই অরবিন্দের ইউএসপি

আমলার চাকরি ছেড়ে আন্দোলন, সেখান থেকে রাজনীতি, সাধারণ মানুষের জন্য লড়ে যাওয়ার মরণপণ জেদ কখনও ছাড়েননি অরবিন্দ কেজরীবাল‘মাফলার ম্যান’ কথা দিলেন, ক্ষমতায় এলে, দিল্লিবাসীকে বিনামূল্যে জল দেবেন। কথা রেখেছেন তিনি। তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের শেষ পাঁচ বছরে দিল্লির ৯৩ শতাংশ বাড়িতে পৌঁছেছে পানীয় জল। এই মরণপণ জেদই অরবিন্দের ইউএসপি। 

Advertisement

অনমিত্র সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share:

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

২০০৮ সাল। তীব্র জলসঙ্কটে দিল্লি। সমস্যা মেটাতে বিশ্ব ব্যাঙ্কের কাছে ছ’বছরের জন্য ১২০ কোটি টাকা ধার নেওয়ার কথাবার্তা প্রায় পাকা করে ফেলেছে শীলা দীক্ষিতের সরকার। দিল্লি জল বোর্ড বেসরকারি হাতে চলে যাওয়া প্রায় চূড়ান্ত। আন্দোলনে নামলেন অরবিন্দ কেজরীবাল। তথ্য-পরিসংখ্যান দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, আসলে জল আছে। মাঝ পথে ট্যাঙ্কার মাফিয়াদের দৌরাত্ম্যে তা পৌঁছয় না আমজনতার বাড়িতে। বেসরকারি হাতে দায়িত্ব দেওয়াটাও আসলে কাটমানির চক্করে। প্রবল প্রতিরোধে শেষমেশ ভেস্তে যায় চুক্তি। ‘মাফলার ম্যান’ কথা দিলেন, ক্ষমতায় এলে, দিল্লিবাসীকে বিনামূল্যে জল দেবেন। কথা রেখেছেন তিনি। তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের শেষ পাঁচ বছরে দিল্লির ৯৩ শতাংশ বাড়িতে পৌঁছেছে পানীয় জল। এই মরণপণ জেদই অরবিন্দের ইউএসপি।

Advertisement

এই যেমন ২০১৮ সালে দিল্লিবাসীর ঘরে ঘরে রেশন পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিল কেজরীবাল সরকার। বাদ সাধেন উপরাজ্যপাল অনিল বৈজল। অন্য দিকে, সে সময়ে কর্মবিরতির ডাক দিয়ে বসে রয়েছেন দিল্লি প্রশাসনের আমলারা। পরিস্থিতি প্রতিকূল। পাল্টা চাপের রাস্তায় হাঁটলেন কেজরীবাল। রাতারাতি উপরাজ্যপালের রাজ নিবাসে ধর্নায় বসে পড়লেন তিনি ও তাঁর তিন মন্ত্রী। ন’দিনের মাথায় সেই ধর্না উঠল। তত দিনে, রেশন প্রকল্পে সবুজ সঙ্কেত দিতে বাধ্য হয়েছেন উপরাজ্যপাল, পিছু হটে কাজে যোগ দিয়েছেন আমলারাও।

হরিয়ানার হিসারে ১৯৬৮ সালের ১৬ অগস্ট জন্ম অরবিন্দের। আইআইটি-খড়্গপুর থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। পাশ করেই জামশেদপুরে টাটায় চাকরি। মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছায় টাটার সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার দফতর চেয়ে ব্যর্থ হওয়ায় চাকরি ছেড়ে দেন। সেই সময়েই কলকাতা আসা এবং মাদার টেরিজার সঙ্গে সাক্ষাৎ। তাঁর সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছাপ্রকাশ করেন তিনি। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিলেন। শিকে ছিঁড়ল ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিসে। পরের বার ফের পরীক্ষায় বসলেন। কিন্তু একই ফল। শেষ পর্যন্ত তাতেই যোগ দিলেন কেজরীবাল। মুসৌরিতে প্রশিক্ষণের সময়েই আলাপ সেই ব্যাচেরই সুনীতার সঙ্গে। বিয়ে ১৯৯৫ সালে। তাঁদের এক ছেলে ও এক মেয়ে।

Advertisement

চাকরি করতে-করতেই ১৯৯৯ সালে গঠন করলেন সংগঠন—‘পরিবর্তন’। রেশন ব্যবস্থার দুর্নীতি রোখা, বিদ্যুৎ চুরি আটকানো। পাশে পেলেন এক সাংবাদিককে— মণীশ সিসৌদিয়া। তথ্যের অধিকার আইনকে হাতিয়ার করে সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতির পর্দা ফাঁস হয় দিল্লিতে। সবেতন ছুটি নিয়ে সংগঠনের কাজ সামলাতে গিয়ে সরকারের সঙ্গে সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়েন। শেষে ২০০৬ সালে চাকরি থেকে ইস্তফা। সে বছরেই তথ্যের অধিকার আইনের মাধ্যমে সমাজের নিচু তলার মানুষকে শক্তি জোগানো ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁদের আওয়াজ তোলার প্রেরণা হওয়ায় উঠতি নেতা হিসেবে রামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পেলেন।

২০১০ সাল থেকে জন লোকপাল আইন রূপায়ণের দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলনে নামেন কেজরীবাল। জন লোকপালের দাবিতে যন্তর মন্তরে অনশনে বসেন অণ্ণা-কেজরীবালেরা। চাপে পড়ে জন লোকপাল বিল আনার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কিন্তু সরকারের খসড়া লোকপাল বিল দুর্বল হওয়ার যুক্তিতে তা খারিজ করে দেন কেজরীবালেরা। ফের অনশনে বসেন কেজরীবাল। তত দিনে অণ্ণার পরিবর্তে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠেছেন তিনি।

কেজরীবাল বুঝেছিলেন, দেশ বদলাতে হলে ভোটে জিতে আসা জরুরি। তাই ২০১২ সালে আম আদমি পার্টি গঠন। ২০১৩ সালের প্রথম নির্বাচনেই কংগ্রেসের সাহায্যে দিল্লির সরকার গড়েন কেজরীবাল। দিল্লির জন্য আনেন লোকপাল বিল। কিন্তু কংগ্রেস-বিজেপি একজোটে বিরোধিতা করায় সরকার পড়ে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হলে, ভোটাভুটির আগেই ইস্তফা দিয়ে দেন কেজরীবাল। ২০১৫ সালে দিল্লিতে ফের নির্বাচন। প্রবল মোদী ঝড় রুখে বিধানসভায় ৭০টির মধ্যে ৬৭টি আসনে জিতে নেয় আম আদমি পার্টি। দ্বিতীয় বার মুখ্যমন্ত্রী হন কেজরীবাল। পাশ করান জন লোকপাল বিল। যা গত পাঁচ বছর আটকে রয়েছে কেন্দ্রের ছাড়পত্রের অপেক্ষায়।

তাতে অবশ্য কেজরীবালের ২০২০ সালে মসনদে ফেরা আটকায়নি। মেরুকরণের প্রবল চেষ্টার জবাব তিনি দিতে চেয়েছেন ঝাঁ চকচকে সরকারি স্কুল, মহল্লা ক্লিনিক, বিনামূল্যে বিদ্যুতের মতো কাজের প্রচারে। বিতর্কে ছেলেবেলা থেকেই ভাল বলে রাজনীতির যাবতীয় আক্রমণের জবাব দেন অক্লেশে। চড়া শুগার। তবু দরকারে অনশনে বসতে আজও এক কথায় রাজি। আসলে কেজরীবাল জানেন দুর্নীতিকে দুরমুশ করা এক জন সৎ ও কাজের মানুষ, দিল্লিবাসীর ঘরের ছেলে তাঁর অনেক যত্নে গড়া ভাবমূর্তি।

‘নায়ক’-এর অনিল কপূরকে মনে পড়ে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন