লাভ-ক্ষতির অঙ্কটা এ বার মিলিয়ে দেখার সময় এসেছে। দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে জরুরি ছিল মুদ্রা প্রত্যাহার— গোটা দেশকে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর চেয়ে নেওয়া পঞ্চাশ দিন নয়, তার চেয়ে একটু বেশি সময়ই অতিবাহিত। সকলেই এ বার জানতে চাইছেন, গত পঞ্চাশ বা পঞ্চান্ন বা ষাট দিনে দেশ বা জাতির স্বার্থ কতখানি সুরক্ষিত করা গেল? নাগরিক জানতে চান, জাতীয় অর্থনীতি কতখানি লাভবান হল?
লাভ-ক্ষতির হিসেবটা আজ সরকারের কাছ থেকে চাইতে হচ্ছে, এটাই দুর্ভাগ্যজনক।
প্রথমত, লাভ-ক্ষতির হিসেব চাওয়ার প্রশ্নটাই ওঠা উচিত ছিল না। কারণ, ফেলে আসা পঞ্চাশ দিনটার ও পারে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, এ পারটাতে পৌঁছতে পারলেই টের পাওয়া যাবে সুফলটা। কিন্তু, এ পারে এসে কোনও সুফল এখনও টের পাওয়া গেল না।
দ্বিতীয়ত, অর্থশাস্ত্রের কোনও গূঢ়তর মাপকাঠিতে মুদ্রা প্রত্যাহারের কোনও সুফল যদি ধরা পড়েও থাকে, যে সুফল সাদা চোখে দেখা যায় না, তা হলে সে বিষয়ে দেশবাসীকে অবহিত করার উদ্যোগ সরকারের তরফ থেকেই গৃহীত হওয়া উচিত ছিল। নাগরিককে প্রশ্ন তোলার অবকাশ দেওয়া এ ক্ষেত্রে অন্তত দেওয়া উচিত ছিল না। কিন্তু, নাগরিককেই প্রশ্নটা করতে হল। ৮ নভেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ষাট দিন কাটিয়েও সরকার কোনও হিসেব দিল না।
সরকার হিসেব দিক বা না দিক, লাভ-ক্ষতির অঙ্ক মেলানোর পালাটা কিন্তু শুরু হয়ে গিয়েছে। মুদ্রা প্রত্যাহারের আগে বাজারে যা কিছু জাল টাকা আর কালো টাকা ছিল, সে সবের ব্যাঙ্কে ফেরার রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে বলে জানিয়েছিল সরকার। কিন্তু, আন্তর্জাতিক সমীক্ষক সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, বাতিল হওয়া নোটের প্রায় পুরোটাই ব্যাঙ্কে ফিরেছে। তা হলে লাভ হল কী? এতগুলো মৃত্যু, দু’মাস ধরে নাগরিকদের এত কৃচ্ছ্রসাধন, ব্যাঙ্ক কর্মীদের এত পরিশ্রম, সরকারের এত খরচ, ব্যবসা-বাণিজ্যে এত ধাক্কার পর কী পেল দেশ? কোথায় গেল জাল টাকা? কালো টাকাই বা জব্দ হল কোথায়?
অনেক প্রশ্ন। সে সবের উত্তর দেওয়া খুব জরুরি। কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী কিছু বলছেন না। আর অর্থমন্ত্রী বলছেন, আন্তর্জাতিক সমীক্ষকদের রিপোর্ট সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না।
নীরব থেকে বা প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে কিন্তু রেহাই মিলবে না। মুদ্রা প্রত্যাহারের মতো পদক্ষেপের সুফল টের পাওয়া না গেলেও, দেশের অর্থনীতিতে কতটা ধাক্কা লেগেছে, তা কিন্তু ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। নোট বাতিলের প্রভাবে আর্থিক বৃদ্ধি মন্থর হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন দেশের রাষ্ট্রপতি। দীর্ঘ দিন দেশের অর্থ মন্ত্রক সামলে আসা এবং বিচক্ষণ তথা অভিজ্ঞ রাজনীতিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করা প্রণব মুখোপাধ্যায়ের এই মূল্যায়ণ কিন্তু যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। নরেন্দ্র মোদীও নিশ্চয়ই তা বুঝতে পারছেন। অতএব আর চুপ করে থাকা চলে না।
জবাব কি আসবে? সরকারের এই পদক্ষেপে দেশ কতটা উপকৃত হল বা অর্থনীতির কতটা ক্ষতি হল, সে অঙ্ক কি সাধারণ নাগরিককে জানানো হবে?
পরিস্থিতি এখন যেমন, তাতে খাঁটি হিসেবটা প্রকাশ করার জন্য যথেষ্ট সৎ সাহস দরকার। যদি সে সৎ সাহস দেখাতে পারে নরেন্দ্র মোদীর সরকার, তা হলে রাজনৈতিক লাভ সম্ভবত হবে না, কিন্তু নৈতিক অবস্থানটা দৃঢ় হতে পারে। আর হিসেবটা যদি প্রকাশ করা না যায়, তা হলে জনসাধারণকেই নিজেদের মতো করে অঙ্ক কষে নিতে হবে।