আমেরিকার ইতিহাসে এই প্রথম বার শতাধিক মহিলা নির্বাচিত হয়েছেন আইনসভার নিম্নতর কক্ষ হাউস অব রিপ্রেজ়েনটেটিভস-এর সদস্য হিসেবে। সামগ্রিক ভাবে, জয়ী নারী প্রার্থীদের মধ্যে ৯ জন ছিলেন রাজ্যপাল পদপ্রার্থী, ১০১ জন হাউস অব রিপ্রেজ়েন্টেটিভস-এর এবং ১৩ জন সেনেটের। রাষ্ট্রপুঞ্জের স্বীকৃতি পাক না পাক, সমস্ত মিডিয়ার পাতায় পাতায় ২০১৮ তাই নির্দ্বিধায় স্বীকৃত হল ‘নারীবর্ষ’ হিসেবে।
উল্লেখ্য যে, অনেক নেত্রীই তাঁদের নিজস্ব ‘মি টু’ অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়েছিলেন এ বারের নির্বাচন প্রচারে। মেয়েদের এই সফল অভিযানের পিছনে অনেক কারণ আছে। একটি কারণ নিশ্চয়ই ‘মি টু’। ২০১৭-য় আমেরিকায় নৈতিক অনাচারের প্রেক্ষাপটে এই আন্দোলন লতাপাতা মেলে বিকশিত হয়েছিল মূলত কর্মক্ষেত্র বা প্রতিষ্ঠান-ভিত্তিক ‘মেল-শভিনিজ়ম’-এর অহংকে চ্যালেঞ্জ করে। দীর্ঘ সময় জুড়ে নারীত্বের বিরুদ্ধে জাতীয় নেতার ক্ষণে ক্ষণে জ্বলে ওঠা অসতর্ক মন্তব্যের বিপক্ষে প্রতিরোধ হিসেবে আজ জ্বলে উঠেছে নারীর আত্মসম্মান। নিন্দুকদের ধারণা, ওই রকম প্রকাশ্য আলটপকা মন্তব্যের ধারা এই প্রেক্ষিত রচনা না করলে মি টু আন্দোলনের এই তীব্রতা সম্ভব হত না।
কিন্তু ‘মি টু’ কথাটার একটা বৃহত্তর তাৎপর্যও চোখ এড়ায়নি আমাদের। মনে রাখতে হবে, আমেরিকাতেও কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য বিস্তর। মহিলারা একই পদে সমকর্ম-অধিকারী হয়েও আজও সমবেতন পান না। এবং শেষ পর্যন্ত লড়ে গিয়েও তাঁকে ‘উচ্চপদটি’র জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হতে হয়, সমযোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও। এই গভীরতর পরিপ্রেক্ষিতটি কোনও অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই, বঞ্চনার কারণ বিশ্লেষণের মধ্যে আত্মতৃপ্তি খুঁজেই শুধু নয়, তার উপশম হিসেবে মেয়েরা বেছে নিয়েছিলন এই অন্তর্বর্তী নির্বাচনকে। তাঁরা নির্বাচনে দাঁড়িয়ে প্রমাণ করলেন, যে হাত দোলনা দোলায়, সে হাত রাজ্যও শাসন করে। জর্জিয়ার গভর্নর স্টেসি আব্রাহামের নির্বাচনী প্রচারে ওপরা উইনফ্রি ঘোষণা করলেন যে, “লেট ইয়োর ভ্যালু ভোট অ্যান্ড লেট ইয়োর ভোট কাউন্ট, স্পিক অ্যান্ড মেক আ ডিফারেন্স।”
এই প্রেক্ষাপটেই শোষিত, দমিত, অত্যাচারিত-অপমানিত নারীত্বের প্রতীক ‘মি টু’ শব্দবন্ধটির চোখের কোণের জল মুছিয়ে, এক অগ্নিবলয়ের শব্দবন্ধ হিসেবে তাকে উদ্ধার ও উচ্চারণ করলেন ২০১৮-এর নির্বাচিত এই নারীরা। ‘মি টু’ মানে শুধু ‘আমিও অত্যাচারিত’ নয়, ‘আমিও পারি’— এই অনুচ্চারিত বার্তা বহন করলেন তাঁরা। নারীর অবস্থান ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে সমাজের ক্যানভাসে দেখালন তাঁরা তাঁদের নতুন চেহারা, নতুন মুখ।
শুধু নারী নয়, নারীকে উপলক্ষ করে ‘সংখ্যালঘু’-র মর্যাদা পুনরুদ্ধারিত হল এই নির্বাচনে। নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন যে ২৭৬ জন নারী, তাঁদের এক তৃতীয়াংশ ‘কালারড’। ম্যাসাচুসেটস কংগ্রেস নির্বাচিত করল তাদের প্রথম আফ্রিকান আমেরিকান মহিলা সদস্য, আয়ানা প্রেসলি-কে। নির্বাচনের জনপ্রিয় প্রতিনিধি ছিলেন ইন্ডিয়ান বা নেটিভ-আমেরিকান ‘পুয়েবলো লাগুনা’ জনজাতির সভ্য দেব হালেও। সেনেটেও জিতলেন ‘হোচ্যাংক’ জাতীয় প্রথম নেটিভ আমেরিকান প্রতিনিধি শেরিস ডেভিডস। সফল হলেন মিশিগানের রশিতা তলাইব। সফল হলেন ১৯৯০ সালে সোমালিয়ার সরকার-পতন ও গৃহযুদ্ধের পর আমেরিকায় উদ্বাস্তু ও শরণার্থী, মিনেসোটার ইলহান ওমর, যিনি ৭৮ শতাংশ ভোট পেয়ে কংগ্রেসের আসন জিতে নেন নভেম্বর মিনেসোটা-র রাজ্য প্রতিনিধি হিসেবে। শুধু তা-ই নয়, তিনি প্রথম সোমালিয়ান আমেরিকান, প্রথম মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি, প্রথম ‘ওম্যান অব কালার’, কংগ্রেসের প্রথম হিজাব পরিহিত শরণার্থী মুসলিম নারী, যিনি হাউস অব রিপ্রেজ়েনটেটিভস-এ নেতৃত্ব দিতে পৌঁছেছেন রাজ্য প্রতিনিধি হিসেবে। তিনি শপথ নেবেন আসসালাম আলাইকুম বলে, কোরানে হাত রেখে। তিনি বলেছেন, পথকিনারে দাঁড়িয়ে তাঁরা বহু রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিকে ভেসে যেতে দেখেছেন। তাই একপেশে সিদ্ধান্ত প্রতিহত করতে, ‘আর বিলম্ব নয়’। সংখ্যালঘুদের লড়াই আজ অস্তিত্বের সম্মান আদায়ের জন্য নয়, তাঁরা অর্জন করেছেন সর্বস্তরের মানুষের কাছ থেকে নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্যতা।
বৈচিত্রের শেষ নেই। কানসাস রাজ্যের আইনসভায় এলেন প্রথম এলজিবিটিকিউ সভ্য। মাত্র ২৯ বছরের আলেকসান্দার ওকাসিয়ো কর্তেস সর্বাপেক্ষা কমবয়সি মহিলা হিসেবে নির্বাচিত হলেন কংগ্রেসে। রিপাবলিকান প্রতিনিধি মার্শা ব্ল্যাকবার্ন নির্বাচিত হলেন টেনেসি রাজ্যের প্রথম মহিলা সেনেটর হিসেবে। মেক্সিকো রাজ্য নির্বাচন করল মিশেল লুজ়ান গ্রিশামকে তাঁদের প্রথম গণতান্ত্রিক ‘ল্যাটিনো’ গভর্নর হিসেবে। ঠিক একই ভাবে জেনেট মিলস নির্বাচিত হলেন মেইন-এর প্রথম নারী রাজ্যপাল হিসেবে। অভিবাসী কিম হলেন কংগ্রেসের প্রথম কোরিয়ান-আমেরিকান মহিলা সদস্য। পুরুষদের মধ্যে জারেড পোলিস প্রথম প্রকাশ্যে ঘোষিত সমকামী রাজ্যপাল যেমন নির্বাচিত হলেন রাজ্যে, তেমনই কলোরাডো রাজ্যের ইতিহাসে তিনিই প্রথম ইহুদি গভর্নর। একই ভাবে ক্রিস পেপারস নিউ হ্যাম্পশায়ারের প্রথম ঘোষিত সমকামী সভ্য হলেন কংগ্রেসের।
নারী, সংখ্যালঘু, অশ্বেতাঙ্গ, সমকামী— এঁরা সকলে সম্মান প্রদর্শনের আর্জি বা দাবিদাওয়ার অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসে স্পষ্ট করলেন তাঁদের অর্জনের উচ্চারণ। ‘ভিক্টিমাইজ়ড’দের যুগসঞ্চিত ভূরি ভূরি ভুক্তভোগের সোপান পেরিয়ে অর্জিত হল বিজয়। এ ভাবেই একটি উন্নত দেশের স্বাধীন চেতনার সাফল্যের বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়। হতাশার দিনলিপি গেঁথে নয়, মি টু–উত্তর বিপ্লব-এর গৌরবগাথা লিখে, যে গাথা বলে— অনেক কালিমার মূল্য দিয়েও ইতিহাস কেমন করে তার পরবর্তী অধ্যায়ে স্বাধীন চেতনা উন্মেষের অর্জনবোধ লিপিবদ্ধ করে। সেই কাহিনির শক্তিশালী কাঠামোর ওপর ভিত্তি করেই এই বিজয়।
নির্বাচনের মাধ্যমেই একটা প্রতিরোধদুর্গ তৈরি করে মেক্সিকো-আমেরিকার মধ্যে প্রাচীর তোলার মতো এক ‘উড়ুক্কু প্রতিশ্রুতি’র বিপক্ষে একটা প্রতিরক্ষার প্রকরণ রচনা করে, ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্সেস’-এর কাঠামোকে দৃঢ়তর করে, এই ‘অভিবাসীর দেশ’ অন্তর্বর্তী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা প্রকাশ করেছে। আগামী বছরগুলিকে সামনে রেখে নীল ঢেউয়ের জোয়ারের হাত ধরেই কি আবার ‘অভিবাসীর যুক্তরাষ্ট্রে’ প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে গণতন্ত্রের নবজাগরণ?